গর-গর-গর
বাঘটা এগিয়ে আসছে। পেঁপে ভাইয়ার চোখমুখ শুকিয়ে
কাঠ। বাঘ তার দিকে এগোচ্ছে। ধীরে ধীরে। কিন্তু ভাইয়া সাহস হারায়নি। বাঘও তৈরি, ভাইয়াও
তৈরি। বাঘ লাফ দিলো, ভাইয়াও লাফ দিলো। মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে। তিন, দুই, এক.......ঢিসুম!!!!
Ôআমার টু হান্ডেড ফোট্টি ফাইভ ওজনের একটা ঘুষি খেয়ে বাঘ ফোট্টি থ্রি গজ দূরের খালের ওয়াটারে হাবুটুবু খেতে লাগলো।’
হাতের আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে, মুখের নানা অঙ্গভঙ্গি
করে পেঁপে ভাইয়া আমাদের গল্প শোনাচ্ছিলো। গরম গরম লেবু চা আর নরম নরম গ্লুকোজ বিস্কুটের
সাথে পেঁপে ভাইয়ার এই বে-শরম বে-শরম আজগুবি গল্প বেশ জমেছিলো। আমরাও মাঝে মাঝে পেঁপে
ভাইয়াকে পাম দেওয়ার জন্য wow,
fantastic, fabulous, wonderful এইসব ভারি ভারি
ইংরেজি প্রসংসা করছিলাম। পেঁপে ভাইয়াও আরো বেশি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গল্পের তেজ বাড়িয়ে
দিচ্ছিলো।
আজকে ন্যাড়া অনুপস্থিত। বিশেষ কোনো কাজে কোথাও
একটা গেছে। কারণটা বলে নি, ফিরে এসে বলবে বলেছে। আমরা এখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছি।
বেশিক্ষণ আমাদের অপেক্ষা না করিয়ে ন্যাড়া তিড়িংতিড়িং
করে চলে এলো।
ন্যাড়া আসামাত্র বোম বলে উঠলো, Ôঐ নাড়্যা, কুন কামে আটক্যা গেছিলু রে? এত দেরি হইল ক্যা?’
খেপু আবার ভুল শুনেছে। সজোরে বলে উঠলো, Ôজেরী? বলো কী বোমদা! জানিয়া রাখিও আমরা এই মুহূর্তে আহমদ দাদা চায়ের দোকানে বসে সংবাদ
দেখিতেছি। কার্টুন
দেখতাছি না। তুমি তাহা
হইলে টম আর জেরির বার্তা কোথা হইতে নিয়ে আসিলে?’
আমি বললাম, Ôআরে, ন্যাড়াকে আগে বলার মওকা দে! এত প্যাচাল ধরলে ন্যাড়া সব বাৎ কীভাবে বলবে?’
ন্যাড়া বলল, Ôবে-বে-বে-বেশি গল্প নেই। আমাদের সু-উ-উন্দরবন যেতে হবে। আমাদের মানে আমাদের পাঁচজনের। যাওয়া একেবারে
বা-বা-বা-আধ্যতামূলক। আমাদের জন্য ভা-ভা-ভা-আইজান অপেক্ষা করছেন। দুই দিন আগেই বের
হব। তৈরি
হয়ে নিও স-স-স-বাই।’
এই
প্রস্তাবনা শুনে পেঁপে ভাইয়া বিষম খেয়ে উঠলো। কাশতে কাশতে একেবারে
যাচ্ছেতাই অবস্থা! একটু পর কাশি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, Ôতুই আমাদের পেরমিসসিওন না নিয়েই যাওয়ার তারিখ ফিনালে করে ফেলেছিস?’
ÔPermission কেন নি-ই-ইতে হতো?
এসব জায়গায় যা-যা-যা-আওয়ার জন্য তো তুমি তিন পায়ে খাড়া!’
Ôতা তো রাইঘট টেল করেছিস!’ পেঁপে ভাইয়া থমথম
খেয়ে বলল। ‘বিউটি ফরেস্টে না গেলে চউন্টোরাই কে চিনবো কীভাবে?’
ÔRight, right, একেবারে right ব-ব-ব-লেছ। এসব
জায়গায় না গেলে জানাই যাবে না যে আমাদের country কত সুন্দর!’
Ôএই শোন বিউটি ফরেস্টে নাকি বাঘ আছে?’ পেঁপে
ভাইয়া কী যেন একটা চেপে গেলো।
বোম
উত্তর দিলো, Ôহ্যাঁ হ্যাঁ আছেই তো। খালি বাঘ কও
ক্যা? রয়েল বেঙ্গল টাইগার কও, রয়েল বেঙ্গল টাইগার! যে সে বাঘ পাইছাই নাকি যে খালি বাঘ
কবে?’
Ôশালী বাঘ?’ খেপু ভুল শুনে ফেলে। Ôবাঘের শালী আছে নাকি? ব্যাঘ্রের বিবাহ কবে হইল?’
ন্যাড়া
খেপুর হাতে একটা কটন বাড গুঁজে দেয়। আর মুখে বলে, Ôএই নে, নতুন কটন।
যা, ওইখানে গিয়ে ভালো করে কা-কা-কান চুলকিয়ে আয়।’
Ôশোন, বেঙ্গল
টাইগার হোক, আর হিন্দি টাইগার! কোনো টাইগারের মুখোমুখি হওয়ার কোন ইন্টেনসিওন এখন আমার
নাই,’ পেঁপে ভাইয়া হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে দেয়।
কিন্তু বলেও যে কোনো লাভ হবে না সেটা বোধহয় ভাইয়া
জানতো। অন্যসময় তার এ কথার বিরোধিতা যদি কেউ করত, তাহলে আর কথা নেই, সোজা কাটু চড় বসিয়ে
দিত। কিন্তু একটু আগেই রঙ চড়িয়ে চড়িয়ে যে বীরত্বপূর্ণ কাহিনী পেঁপে ভাইয়া আমাদের শুনিয়েছে,
তাতে নিজেই নিজের কথার বিরোধিতা করে বসে আছে। হয়তো আশা করেছিলো, কেউ ধরতে পারবে না।
কিন্তু Ôকেউ’ নামক কোনো লোক জিনিসটা ধরতে না পারলেও, আমাদের বোম বাবাজী ঠিকই ধরে ফেলল।
বলল, Ôতাইলে এতক্ষণ
যে গল্পটা আমাদের শোনাচ্ছিলে, সেইডো গুলগপ্প আছিলো নাকি?
আমি পেঁপে ভাইয়াকে কিছু না বলার সুযোগ দিয়েই বলে উঠলাম,
Ôনা, না।
তোমাকে না নিয়ে হামলোগ নাহি যায়েংগে! মাইন্ড ইট! তাছাড়া, তোমাকে নিয়ে না গেলে আমাদের
নিরাপত্তা কে দেবে? বাঘকে তো তুমিই ঘায়েল করোগে!’
কোন
উত্তর দিলো না পেঁপে ভাইয়া। টলতে টলতে আহমদ ভাইয়ের কাছে গেল। চায়ের কাপ রেখে বিল পরিশোধ
করলো। তারপর ওই যে বাড়ির মুখে দৌড় দিল, ওইদিন আর তার দেখা পাওয়া গেল না।
সত্যি
কথা হচ্ছে কেবল ওই দিন নয়, পেঁপে ভাইয়াকে পাড়ায় আর দেখাই যাচ্ছে না। কোথায় যায়, কী
করে, কিছু জানা যায় না। ন্যাড়ার বাড়ি ভাইয়ার বাড়ির সবচেয়ে কাছে। বলতে গেলে পাশাপাশি।
সেও পেঁপে ভাইয়ার দেখা পায় না। যখনই যায় খোঁজ নিতে, তখনই খবর পায় বাড়িতে ভাইয়া নেই।
২
যাত্রার
দিন এসে গেলো। আমরা সবাই তৈরি হয়ে নিলাম। সবকিছু গুছিয়ে সবাই একত্রিত হলাম ন্যাড়ার
বাসায়। সকাল সকাল গেছি। ওর ঘরের দরজা খোলা-ই ছিলো। আমরা ঘরে ঢুকে দেখি ন্যাড়া এখনও
লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। অক্টোবরে ঠান্ডা একটু-আধটু লাগে জানি, কিন্তু তাই বলে লেপ
কেন গায়ে দিতে হবে, এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের মাথায় এলো না। সকলে মিলে ওকে টেনে তুললাম।
সেও পরিষ্কার হতে খানিকটা সময় নিলো। সেই সুযোগে আমরা ওর কম্পিউটারে নতুন একটা গেম খেলে
নিলাম। গেমটা ছিলো Heroes of 71, যুদ্ধের গেম।
ন্যাড়া
কে সাথে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য ভাইয়ার বাড়ি। দরজায় কড়া নাড়তেই দরজা খুলে
দিলেন স্বয়ং ভাইয়ার মা জননী। হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় করলেন। পরিশেষে বললেন, Ôতোমাদের ভাইয়ার ঘরে চলে যাও। তাহলে তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।’
আমরা
সোজা ঢুকে পড়লাম। ভাইয়ার ঘরে। গিয়ে দেখি ভাইয়ার বিছানায় আর্মি সিটের তৈরি সব শার্ট,
থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, গেঞ্জি ইত্যাদি এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। আরেকটা ব্যাগ দেখলাম।
সেটাও আর্মি ধাচের। ইতোমধ্যে ভাইয়া গোসলখানা থেকে বের হয়ে এলো। পরনে ছিলো একটা গামছা।
ভাইয়া
আসামাত্র ন্যাড়া বলে উঠলো, Ôস-স-স-সব তো আছে
ভাইয়া, কিন্তু জাংগিয়া কই? ওইটা তো দেখতে পা-পা-পা-’
পেঁপে
ভাইয়া উত্তর করলো, Ôআন্ডার প্যান্ট
কি তোদের সামনে ঝুলিয়ে রাখবো নাকি রে? এই দ্যাখ!’
এই
বলে ভাইয়া একটানে তার পরনের গামছা খুলে ফেলল। আমরা দেখলাম ওটা জাংগিয়া নয়। কোমর হতে
হাটুর উপর পর্যন্ত লম্বা একটা পাতলা ঢিলেঢালা প্যান্ট। হাফ প্যান্ট। বলাবাহুল্য, সেটাও
আর্মি কোয়ালিটি।
Ôএ ভাই, সুন্দরবনে
গেরিলা আক্রমণ করতে যাচ্চাও নাকি?’ বোম উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করে।
আমি
বললাম, Ôআরে না রে, আমাদের পেঁপে ভাইয়া সুন্দরবনের
নাইট গার্ডের চাকরি পেয়েছে কিনা। তাই তৈয়ারী কররাহাহে। সাহি পাকড়া না?’
পেঁপে
ভাইয়া বোধহয় আমার কথা শুনতে পায়নি। বোমের কথা ধরেই সে বলে উঠল, Ôআক্রমণ করবে। সুরে আট্টাচক করব। কিন্তু গরিলার উপরে নয় রে, সোজা টাইগারের
উপরে!’
Ôকথাটা হবে sure
attack,
বুঝলে?’
Ôচুপ কর। আর শোন, ট্রেনিং নিতে গিয়ে আমি---’
নিজের
কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। পেঁপে ভাইয়া ট্রেনিং নিতে গেছে। একেবারে অবিশ্বাস্য।
আমার কাছে আরো বেশি অবিশ্বাস্য ঠেকলো। তাই পেঁপে ভাইয়াকে কথার মাঝখানে থামিয়ে জিজ্ঞেস
করলাম, Ôতুমি ট্রেনিং গিয়েছিলে?’
বোম
বলল, Ôকিসের ট্রেনিং লিয়ে আইছাও?’
Ôবাঘ মারার ট্রেনিং রে, বাঘ মারার ট্রেনিং!’
পেঁপে ভাইয়া উত্তর করলো।
আমি ফোড়ন দিলাম, Ôপিঁপড়া যদি হাতিকে থেতলে দেওয়ার ট্রেনিং
নিতে যেত, তবুও বিশ্বাস করতাম। কিন্তু তুমি গেছ বাঘ মারার ট্রেনিং নিতে, এটা ঠিক বিশ্বাস
হচ্ছে না।’
পেঁপে
ভাইয়া গর্জে ওঠে। বলে, Ôতা নয়তো কী রে নসু?
এই দ্যাখ, প্রুফ ব্রিং করেছি।’
পেটে
ভাইয়া প্রমাণস্বরূপ একটা বিশাল বন্দুক বের করে আমাদের দেখালো। সেটা দেখার পর খেপু জিজ্ঞেস
করলো, Ôবন্দুকখানি আসল তো?’
Ôক্ষ্যাপাচরণ মজুমদার, সাবধান খবরদার! বন্দুকের
ওপর নিন্দুকগিরি চালালে সিন্দুকে পুরে দেব! আন্ডারস্ট্যান্ড!
আমি
বললাম, Ôমজুমদার, খবরদার, বন্দুক, নিন্দুক, সিন্দুক!
ওয়াও! কেয়া বাত! ভালোই প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলতে হচ্ছে।’
Ôএটা মোটেও আমার ট্রেনিংয়ের পার্ট নয়।’
Ôঅনেক প্যাঁচাল হয়েছে,’ ন্যাড়া বলে উঠলো,
Ôদেখব কেমন ট্রেনিং নিয়েছ। এবারে চলো, দেরি
হয়ে যাচ্ছে।’
Ôপুনরায় জেরী?’
খেপু জিজ্ঞেস করে।
বোম
খেকিয়ে ওঠে, Ôগাট্টা মাইরা ঠাট্টা করবনি। চুপ থাক।’
পেঁপে
ভাইয়া তৈরি হয়ে নিলো। আমরা রওনা দিলাম। তবে ভাইয়া যে কেবল আমাদের সামনে ভাব নেওয়ার
জন্য বন্দুক দেখিয়েছিলো, সেটা বুঝতে বাকি রইলো না। কেননা, ভাইয়া বন্দুক ব্যাগে ঢোকায়ইনি।
কারণ জিজ্ঞেস করলে ভাইয়া বলল যে, সে নাকি বন্দুক হাতে নিয়ে শিখে এসেছে কীভাবে বন্দুক
ছাড়া বাঘের মোকাবিলা করতে হয়!
৩
গন্তব্যে
পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমাদের সর্বশেষ বাহন ছিলো বাস। বাস থেকে
নেমেই দেখি ভাইজান বাসস্ট্যান্ডে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা বাস থেকে নামতেই
তিনি আমাদেরকে স্বাগতম জানালেন।
ইনি
ন্যাড়ার দুঃসম্পর্কের মামাতো ভাই। ন্যাড়ার ফ্যামিলি ট্রি-তে খোঁজ করতে গেলে তাঁকে পাওয়া
যাবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু ন্যাড়ার এরকম আত্মীয় অনেক দেখেছি। তাদের মতো এই ভাইজানের
ব্যবহার দেখলেও বোঝার উপায় নেই যে ইনি সত্যিই ন্যাড়ার দুঃসম্পর্কের মামাতো ভাই।
ভাইজান
লম্বা সুঠাম দেহী। বয়স ২৫ হতে পারে। তেজী জোয়ান। জিম করেন না। কিন্তু তাতেও শরীরের
যে গঠন, দেখলে অবিশ্বাস করতে বাধ্য হতে হয় কথাটা সত্যি। মিলিটারি ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন।
মিলিটারিদের চেহারা এমন হয় শুনেছি, দেখেওছি। কিন্তু ভাইজান নাকি ছোটবেলা থেকেই এরকম
দেহের অধিকারী। ন্যাড়ার বর্ণনা তা-ই বলে।
যাইহোক,
ট্রেনিং শেষে ভাইজানের মাথায় ভুত চাপে। না জানি কোন ভুত, যে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বন
বিভাগে চাকরি করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। মুহূর্তে মিটারের চাকরির ব্র্যাকেট ক্লোজ করে
বন বিভাগের অফিসার হিসেবে ঢুকে গেলেন। কেবল ন্যাড়া মনে করে ভাইজানের মাথায় ভুত চাপে
নি। ব্যাপারটা অন্যরকম। তার অনুমান এরকম যে, হয়তো এমন হয়েছে যে ভাইজানকে কোন রুক্ষ
মরুভূমির মতো জায়গায় ট্রান্সফার করার কথা হয়েছিল। কিন্তু ভাইজানের ভীষণ প্রকৃতিপ্রেমী।
তাই গাছগাছালি ছেড়ে মরুভূমিতে যাওয়ার ইচ্ছা তার মনে ছিল না। বিধায় এখানে এসেছেন।
ভাই
হিসেবে ন্যাড়া যেমন তাকে ভাইজান বলে ডাকে, আমরাও তেমনি ভাইজান বলেই ডাকবো ঠিক করলাম।
পেঁপে ভাইয়ার কী হলো জানিনা, ভাইজানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সবাইকে আদেশ দেওয়া
শুরু করলো, Ôপ্যারেট, সাবধান! প্যারেট, স্যালুট
কর।’
আমরাও
তার কথামতো ভাইজানকে স্যালুট করলাম। শেষে গিয়ে ন্যাড়া ফোড়ন কাটল, Ôপ্যারেট নয় ভাইয়া, কথাটা হবে প্যারেড।’
পেঁপে
ভাইয়া বিরক্তি সংযোগে বলে, Ôহতচ্ছাড়া ন্যাড়া!
আমার কথার টিপ্পনি না কাটলে কি তোর পেটের রাইস হজম হয় না?’
এই
হলো ভাই আর এক দারুণ ক্ষমতা! যখন তখন যে কারো সামনে আমাদের স্পেশাল নাম ধরে ডাকবে।
এতে সামনের লোকটা কী ভাবল, ভাইয়া সেটার ধার ধারে না। তার ভাষায়, Ôএনিটাইম, এনিহোয়ের, তোদের ক্রিয়েটিভ নাম ধরে ডাক দিব, তাতে হু হুইচ হোয়াট
মনে করল, আই ডোন্ট কারে।’
তখনই
ন্যাড়া পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠবে, Ôকেয়ার কেয়ার কেয়ার।’
যাইহোক,
ভাইয়ার কথা শুনে ভাইজান হেসে ফেললেন। খানিকটা সময় হাসির পর তিনি বললেন, Ôএবার বাসায় যাওয়া যাক।’ আমরা তাঁর সাথে বাসায় এলাম।
বাড়িতে
ভাইজান ছাড়াও ভাবি আর দুইটা ছেলে আছে। ও দুটো এখনো দুধের বাচ্চা। তাই কথা বলার মতো
নতুন কোনো সমবয়সীকে পাওয়া গেলো না। রাতে খাবারের পর ছাদে উঠলাম। আমরা পাঁচজন আর ভাইজান।
দুই বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে খানিক্ষণ পর ভাবিও আসলেন। মাদুর পাতা হলো। এবার এখানে বসে
পূর্নিমার চাঁদ দেখতে দেখতে আমরা আমাদের পরিকল্পনা সেরে নেবো।
ভাইজান
প্রথম কথা পাড়লেন। বললেন, Ôনয়ন, তুমি কি ওদেরকে এখানে আসার কারণ বিস্তারিত জানিয়েছ?
ন্যাড়া উত্তর দিলো, Ôসে কী কথা ভাইজান? তুমি তো আমাকে কে-কে-কেবল
এই বাঘ ধরার ক-ক-ক-অথাটা বলেছ। বিস্তারিত কিছু তো বলোনি। তাহলে আমি সবাইকে কিভাবে জানাবো?’
Ôওই দেখো,
আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম,’ ভাইজান হাসতে থাকেন। বললেন, Ôএখন ঠিকই মনে পড়ছে, আমি তোমাকে বলেছিলাম
যে তোমরা আগে সবাই হাজির হও, তারপর সব খুলে বলব। কিন্তু এটুকু কথাই মনে ছিলো না। এই
আমার এক দোষ জানো। কেউ ইঙ্গিত দিয়ে মনে না করিয়ে দিলে সহজ কথা পর্যন্ত ভুলে যাই।’
পেঁপে ভাইয়া বলল, Ôতাহলে এখন যখন আমরা সবাই প্রেজেন্ট আছি, তাহলে এখন এসব কথা ডিসকুস করে ফেলুন।’
Ôভাইয়া, ডিসকুস
নয়। কথাটা discuss হবে।’
এইবার
ভাবিজান মুখ খুললেন। বললেন, Ôপাপ্পু, তোমার কথার
অনুবাদ করার জন্য সব সময় দেখছি নয়নকে থাকতেই হবে।’
Ôনা, না,’ পেঁপে ভাইয়ার সটান জবাব, Ôদেখুন ভাবি। আমি আমার ইংরেজিগুলো একবারে ঠিক ঠিক প্রোনৌন্স করি। কিন্তু
আই ডোন্ট নো হোয়াই আপনার দেবর সহ্য করতে পারে না। এই যে ডিসকুস না বলে আমাকে ডিসকাস
বলতে বলল। আপনি বলুন তো, কোন হিসেবে ও ওর্ডটাকে ডিসকাস বলছে। বানানে তো ইউ আছে। তারপরেও
কোন রেয়াজনে আ-কার লাগিয়ে ডিসকাস বলে। কোথাকার ব্যাকরণবিদ বলুন দেখি।’
Ôওর্ড নয়, ওয়ার্ড। রেয়াজন নয়, রিজন।’
Ôসী করেছেন ভাবি? আগাইন স্টার্ট করলো। এ,
তুই কোন লজিসে ওয়ার্ড বলছিস, কথাটায় A কোথায় পেলি?’
Ôলজিস নয়, লজিক।’
Ôদেখেন ভাবি, দেখেন। আগাইন আপনার দেবর ভুল
টিচ দিচ্ছে। লজিস বানানের শেষে যে C আছে, সেটা আমার
মতো ছাত্রও জানে। কিন্তু ওর মতো ছাত্রও জানে না, C এর সময় স বলতে
হয়।’
ভাবি
বললেন, Ôতাহলে বিড়ালের ইংরেজি বলার সময় ক্যাট বলো
কেন? ওখানেও তো C আছে!’
ভাবির
এই অকাট্য যুক্তির কাছে পেঁপে ভাইয়া একেবারে কুপোকাত। আমতা আমতা করে বলতে লাগলো, Ôক্যাট! হুম। ওই বানানটা ভুল আছে। আসল বানান হবে কে এ টি, ক্যাট।’
বোম
বলল, Ôপেচালের পর পেচাল উঠপিনি বউদি। আমারে দাদার
সাথে কাইয়্যা লাগায়া পারবে নানি।’
Ôও ঠিক বলেছে ভাবিজান-ভাইজান। আপনারা আসলি
বাতোমে আইয়ে,’ আমি বোমকে সায় দিয়ে বললাম।
Ôকথাটা বিড়ালকে
নিয়েই,’ ভাইজান বললেন, Ôআসলে বিড়াল তো নয়, বিড়ালের বোনপো বাঘ! আমাদের সুন্দরবনকে অনেকগুলো ভাগে ভাগ
করা হয়েছে। একমাত্র আমাদের ভাগটা বাদে বাদে বাকি সব ভাগে বাঘ আছে। আমাদের ভাগে বাঘের
উপযোগী কোনো খাবার না থাকার কারণে এখানে বাঘ নেই। কিন্তু একটা বাঘ আমাদের এলাকায়
ঢুকে পড়েছে। বাঘকে যদি বনবিভাগ থেকে নির্বাচন করা খাবার না দেওয়া হয়, তাহলে বাঘ এখানকার
বাকি সব জন্তুর শিকার করবে। কিচ্ছু নির্বাচন রাখবে না। সব খাওয়া শুরু করবে। এতে বনের
মারাত্মক ক্ষতি হবে। তাই আমাদের কাজ হচ্ছে বাঘটিকে বন্দী করে আগের জায়গায় রেখে আসা।’
আমি
বললাম, Ôআমাদের ভাইয়া যখন আছে, তখন আমাদের কোয়িভি
টেনশন নেহি হেই।’
ভাইজানের
কথা শুনে আর আমার মন্তব্য দেখে এতে ভাইয়া বিষম খেতে আরম্ভ করল। খুব জোরে জোরে। পেঁপে
ভাইয়ার অবস্থা দেখে খেপু বলল, Ôব্যাঘ্রের সামনে
উপস্থিত না হইতেই এই অবস্থা হইলে, একটিবার ভাবিয়া দেখো যখন বাঘের সামনে যাইবে, তখন
কেমন অনুভূতি হইবে!’
Ôকী আবার হবি,’ বোম আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,
Ôভাইয়ের এক থাপ্পর খায়া বাঘ নিজের গুষ্টির
নাম ভুইল্যা যাবি।’
ভাইজান
বললেন, Ôব্যাপারটা অত সহজ হবে না। আমার বাহিনীর সবাই
না করে দিয়েছে। কিন্তু তোমাদের কীর্তির কথা আমার খুব ভালোভাবে জানা। জানি, কাজটা খুবই
ঝুঁকির। কিন্তু তবুও বেশি না ভেবে তোমাদেরকে ডেকে পাঠালাম।’
ন্যাড়া
বলল, Ôকিন্তু বা-বা-বা-বাঘকে ধ-ধ-ধ-ধরার জন্য কিছু
প-প-প-প-অরিকল্পনা করা লাগবে নাকি?’
Ôতোমাদের ভাবি আর আমি মিলে ভেবে ভেবে তিনটি
পরিকল্পনার বের করেছি।’
Ôতাহলে সেগুলো এখন আমাদের সামনে উগরিয়ে দিন।’
ভাইজান
আর ভাবিজান মিলে আমাদের পরিকল্পনা বোঝাতে লাগলেন।
পরিকল্পনা Ôক’
আমরা গাছের নিচে
জাল নিয়ে বসে থাকব। নিচে বাঘের জন্য কিছু খাবার রেখে দেওয়া হবে। যখনই বাঘ নিচে আসবে,
আমরা জাল ফেলে দেব।
পরিকল্পনা Ôখ’
একটা গর্ত করা হবে।
তার ওপর পাতা-মাটি ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। আর আগের মতো খাবার রেখে দেওয়া হবে।
বাঘ তা খেতে এসে গর্তে পড়ে যাবে।
পরিকল্পনা Ôগ’
একটা খাঁচা বানানো
হবে। খাঁচার একটা মুখ খোলা রাখা হবে, আর বাকি মুখ বন্ধ। এবারেও খাবার রাখা হবে। আর
বাঘ যেই মুহূর্তে খাবারের লোভে খাঁচায় ঢুকে যাবে, ঠিক তখনই আমরা খোলা মুখটা বন্ধ করে
দেবো।
ভাবিজান
জিজ্ঞেস করলেন, Ôকোনটা ভালো লাগলো?’
Ôতিনটাই আচ্ছা হ্যায়,’ আমি বললাম, Ôলিকিন যেহেতু বাঘ ধরা নিয়ে কথা, তাই মেরে পাস তিন নাম্বারটা ভালো লেগেছে।
মাগার হাম তিনটাকেই ইস্তেমাল করেংগে।’
Ôহ্যাঁ, হ্যাঁ,’ ন্যাড়া বলল, Ôআমরা তিনটাকেই কা-কা-কা-কাজে লাগাবো। একটা না একটাতে তো কাজ হবেই। নাকি?’
Ôখাঁজ হইবে?,’ খেপু চিৎকার দেয়, Ôপরিকল্পনা দিয়া খাঁজ কীভাবে হইবে?’
বোম
বলল, Ôখাঁজ না রে, কাজ। মানে কাম। বুচ্ছু, কাম!’
Ôআর যদি কাজ না হয়, তাহা হইলে কী হইবে?’
পেঁপে ভাইয়া আস্তে আস্তে বলল, Ôএতদিন দেখে এসেছি তোর ভুড়িটা বিগেস্ট। এখন দেখছি তোর
মাউথটা মোস্ট বিগেস্ট!! লক মার এখনি।’
Ôভাইয়া, মোস্ট বিগেস্ট হয়না,’ ন্যাড়া ফিসফিসিয়ে
বলে ওঠে।
ভাবিজান-ভাইজান
হেসে ওঠেন। সাথে সাথে আমরাও। শেষে তো ভাবিজান ন্যাড়াকে চলমান গ্রামারের উপাধিটাই দিয়ে
দিতে চাইছিলেন। সেই কথায় ভাইজান বললেন, Ôকার অনুমতি নিতে
হবে? তুমি দিয়ে দিচ্ছ না কেন?’
Ôআচ্ছা, আমি উপাধি নিলাম। এখন চ-চ-চ-চ-চলো,
সবাই ঘুমিয়ে পড়ি। কাল সকালেই মিশন শুরু করবো। অনেক কাজ প-প-পড়ে আছে।’
সবাই
সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে আমরা সবাই ঘুমাতে চলে গেলাম। আমাদের আলাদা আলাদা ঘরে শোয়ার
ব্যবস্থা হয়েছে। ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছিলো না। দুশ্চিন্তা
কীভাবে তাড়াই? মাথায় বুদ্ধি এলো। আজ সারাদিন কত না ধকল গিয়েছে আমার ওপর দিয়ে, এমন চিন্তা
করতে লাগলাম। আমার মাথা মনে হয় বুঝে গেছে। ঘুমিয়ে গেলাম।
৪
ভাইজান
খুব সকালে ওঠেন। তাঁর সাথে সাথে ওঠে সারা বাড়ি। আমাদেরকেও উঠতে হলো। সকাল সকাল খানিকটা
ব্যায়াম-ট্যায়াম করে নেওয়া হলো। অনভ্যাসে এক কিলোমিটার জগিং করা নেহায়েত সহজ কাজ নয়।
সকালের
নাস্তা সেরে কাজ শুরু হলো। পেঁপে ভাইয়া আর ভাইজান চলে গেল জাল কিনতে। কাঠমিলে ফোন দেওয়া
হয়েছিলো। সকাল সকাল কাঠ দিয়ে গেছে। আমরা লেগে গেলাম খাঁচা তৈরি করতে।
দু-ঘন্টার
পরিশ্রমে খাঁচা তৈরী করে ফেলা শেষ। আমরা কেবল কাঠামো বানিয়ে বেড়া লাগিয়ে দিলাম। দরজা
লাগানোর কাজ ভাবিজান করলেন৷ নিজ হাতে। ওপর নিচে ওঠানামা করতে পারবে দরজা। দরজা ওপরে
তুলে রেখে বাঘকে ভেতরে ঢোকার সুযোগ দিতে হবে। আর ভেতরে ঢুকলে কেবল দরজা নামিয়ে দেওয়ার
কাজ। ব্যাস, কেল্লা ফতে!
খাঁচা
বানানো শেষ। কিন্তু শেষে গিয়ে দেখা গেল গোলমাল। বাধিয়েছে বোম সাহেব। যে কাঠ খাঁচার
তলার দিকে লাগানোর কথা ছিল, সেগুলো অন্যান্যদের তুলনায় পাতলা আর হালকা। হালকা কারণ
সেগুলো মাটির সাথে লেগে থাকবে, ওর ওপর ভর যা পড়বে তা মাটির ওপরেই পড়বে। তাই এ কাঠগুলো
না লাগালেও চলতো। কিন্তু লাগানো হয়ে গেছে। আর আসল কথা হলো, বোম সেগুলো লাগিয়ে দিয়েছে
খাঁচার ছাদের দিকে।
তাহলে
এবার উপায় কী? কঠিন উপায় হলো কাঠগুলো খুলে খুলে আবার জোড়া লাগানো। আর সহজ উপায় হলো
খাঁচাকে উল্টে দিয়ে ছাদকে তলা, আর তলাকে ছাদ বানানো। ন্যাড়া দ্বিতীয় বুদ্ধির কথাই বলেছিলো।
কিন্তু তাতেও সমস্যা। খাঁচা উল্টে দিলে দরজা কাজ করবে না। কাজ করাতে গেলে উল্টো করে
লাগাতে হবে। আর দরজা উল্টো করে লাগাতে গেলে সব আবার ঢেলে সাজাতে হবে। এটা কঠিন উপায়ের
চেয়েও বেশি কঠিন উপায়!
শেষ
পর্যন্ত এভাবেই কাজ চালিয়ে নেওয়া হবে ঠিক হলো৷ এইটুকু ঝুঁকি নিতে তো সমস্যা নেই। খাঁচার
ছাদের ওপর তো কেউ আর ঝাপাঝাপি করতে যাচ্ছে না।
ভাইজান
আর পেঁপে ভাইয়া জাল নিয়ে ফিরে এসেছে। বাজার থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে মজবুত জালটাই এনেছে
ওরা। বাঘ ধরা বলে কথা!
বিকেলের
দিকে গর্ত করার কাজটিও শেষ। গোটা দায়িত্ব নিয়েছে ন্যাড়া। ওর কাজ করার গতি দেখে বুঝলাম,
ওর মুখ অতটা না চললেও হাত দারুন চলে। আর শেষে যেমন সুন্দর
করে গর্তে ওপরে পাতা দিয়ে ঢেকে দিল, তাতে ওকে স্যালুট না দিয়ে পারা গেল না।
প্রস্তুতি শেষ। এবার কালকেই বাঘ ধরা অভিযান শুরু করতে
হবে।
৫
আমরা যে সময়টাকে এগোতে দিতে চাইনা, সেটাই সবচেয়ে দ্রুত
এগিয়ে যায়। বাসে যদি কোনো সুন্দরী মেয়ের পাশে সিট পড়ে, তাহলে আমরা চাই যেন সময়টা দ্রুত
না কাটে, কিন্তু ঠিকই আমাদের চাওয়ার বিপরীত জিনিস সফল হয়। বাস হয় খুব দ্রুত চলে, আর
নাহলে সময় দ্রুত চলে যায়। একইভাবে যদি আমাদের কোনো নিকটাত্মীয়ের হাসপাতালে যাওয়ার মতো
অবস্থা তৈরি হয়, তাহলে আমরা অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করি, আর মনে মনে চাই যেন অ্যাম্বুলেন্স
যত দ্রুত আসতে পারে আসুক। অ্যাম্বুলেন্স হয়তো ঠিক সময়েই এসে পৌঁছবে, কিন্তু আমাদের
মনে হবে যেন অ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে যুগ-শতাব্দী পেড়িয়ে গেছে।
আমাদের এই যাত্রাতেও ঠিক সেটাই হলো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে
প্রার্থনা করছিলাম যেন ঘড়ির কাঁটা আর না নড়ে। কিন্তু হলো তার বিপরীত। ঘড়ির কাঁটা ঠিকই
নড়লো এবং এমনভাবে নড়লো যেন চোখ বুজে এক সেকেন্ড থাকার পরই সকাল হয়ে গেলো। আর বিছানা
ছেড়ে উঠতে হলো।
কেবল ভাবছি বাঘটাকে ধরতে পারবো কিনা। যদি পারি তাহলে
গর্বে অনেক উপরে উঠে যাবো। কিন্তু যদি কোনো ঝামেলার ফলে বাঘের সামনে পড়ে যাই, তাহলে
তো জীবনের তরে উপরে উঠে যাব।
আমরা প্রস্তুত। পেঁপে ভাইয়া তারা আর্মি ড্রেস পড়ে
তৈরি। পেঁপে ভাইয়ার দেখাদেখি ভাইজানও তার আগের রূপ ধরলেন। আমাদের সাহস তাতে বেড়ে গেল
সামান্য বেশি। আর থেমে থাকা হলোনা আমাদের। রওনা দিলাম, ঠিকমত পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট
স্থানে।
আগেই বলেছি, এসব কাজে সময় তাড়াতাড়ি চলে যায়।
দ্বিতীয়
পরিকল্পনা আগে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। বাঘ নাকি হরিণের মাংস খেতে খুব বেশি
ভালোবাসে। ভাইজান অর্ডার দিয়ে নিয়ে এসেছেন। না মানে নিয়ে আসেন নি, অর্ডার দিয়ে এসেছেন।
আর লোকজন এসে পার্সেল দিয়ে যাবে। আমাদের পৌঁছানোর পরে তারাও কাঁচা মাংস নিয়ে হাজির
হলো। তার জন্য যে টাকা দরকার তার সব বনবিভাগের লোকদের ওপর চাপানো হলো বাধ্য সাহায্য
করছে না না হয় অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সাহায্য করুক।
গত
কয়েকদিন ধরে ভাইজান উপরে নজর রেখেছেন। আর তিনি দেখতে পেয়েছেন বাঘ প্রতিদিন একবার করে
হলেও এই জায়গা দিয়ে যায়। তাই পরিকল্পনার জন্য এই জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভাইজান
মাংসপিণ্ডকে ভাগ করে ফেললেন। তিন ভাগ করে, একভাগ অতি সাবধানে গর্তের উপরে রেখে, আমাদের
প্রত্যেককে নিয়ে গাছে চড়ে বসলেন। তিনি আন্দাজ
করতে পেরেছেন, বাঘসাহেব ভিজিট দিতে আসছেন।
মিনিট
পাঁচেক স্তব্ধভাবে কেটে গেল। আর তারপরই বাঘের গরগর আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভাইজানের অনুমান
সত্যি হলো। সামনের একটা ঝোপ থেকে লাফিয়ে বাইরে বের হয়ে আসলেন স্বয়ং বাঘসাহেব। আমাদের
কথা তৎক্ষণাৎ বন্ধ। মুখের কাজ বন্ধ, কিন্তু চোখের কাজ চলছিলো।
বাঘ
গর্তের কাছে এসে গেছে। এসেই করলো কী, গর্তের চারদিক দিয়ে পায়চারি শুরু করলো। মাংসের
উপর দৃষ্টি রেখে সে অনেকক্ষণ গর্তের চারপাশ দিয়ে ঘুরলো। আর তারপরেই দিল লাফ! আমরা নিশ্চিত,
গর্তের ভেতরে পড়বে। কিন্তু না। তা হলো না। এক পাশ হতে লাফ দিয়ে একখণ্ড মাংস মুখে তুলে,
ওই লাফেই গর্তের ওপার চলে গেল। মোটকথা, বাঘ শুন্যে থাকা অবস্থাতেই মাংস মুখে তুলতে
পেরেছে। সেটুকু ভোজন শেষ। আবার একই কাজ করে আর এক টুকরো তুলে নিল। এইভাবে গোটাটুকু
শেষ করলো। আমরা বাঘের বুদ্ধির সামনে বিড়াল বনে গেলাম।
বুঝতে
বাকি রইলো না যে, এভাবে লাফ দেওয়ার জন্যই বাঘ দূরত্ব মেপে নিয়েছিল পায়চারি করে করে।
আর সেটা করতে গর্তের চারদিকে ঘুরছিলো। মাংসটার
শেষের অংশটাও যখন বাঘের পেটে চলে গেল, তখন ভাইজান পেঁপে ভাইয়াকে বললেন ব্যাগ থেকে জাল
বের করতে। পেঁপে ভাইয়া তড়িঘড়ি আদেশ পালন করলো।
জাল বের হওয়ার সাথে সাথে ভাইজান জাল ফেলে দিলেন বাঘের
ওপর। বাঘ তার মধ্যে পুরোপুরি ফেঁসে গেল। একেবারেই নড়াচড়া করতে পারছিলো না। আমাদের সবার তখন
কী যে আনন্দ!!! ইয়াহু বলে সবাই চিৎকার দিয়ে উঠল!
ভাইজান
জালের দড়িটা শক্ত করে গাছের সাথে বাঁধলেন। আমরা সবাই গাছ থেকে নামতে যাবো, এমন সময়
দেখি বাঘ মহাশয় আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে রাগের কোনো চিহ্ন নেই। বরং কেউ সহানুভূতির
দৃষ্টিতে কারো দিকে তাকালে যেমন হাল হয় চোখের, বাঘের চোখেরও ঠিক সেই রকম ভাব দেখলাম।
বাঘ যদি মানুষের মতো মুখের অঙ্গভঙ্গি করতে পারতো, তাহলে নিশ্চয়ই দেখতাম, বাঘ তার মুখ
দিয়ে চুকচুক শব্দ করে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে আমরা কী একটা বোকামি করে ফেলেছি।
যেই
না আমরা গাছ থেকে নেমেছি, অমনি শুরু হল বাঘের তর্জন-গর্জন। এমন গর্জন শুরু হল, যেন
মাটি কাঁপছে। আমাদের সামনে এগোনোর ইচ্ছা হলো না। বাঘ যেভাবে জ্বাল আচড়াচ্ছে, সেরকম
যদি আমাদের সাথেও করে, তাহলে আর দেখতে হবে না। সোজা ওপরে। ভয় পেয়ে আমরা সবাই (কেবল
ভাইজান বাদে) ২০.৯৭ বল খাটিয়ে (পাকা হিসেব), গাছকে আকড়ে ধরলাম।
নিমিষের
মধ্যে বাঘমামা জাল ছিড়ে ফেললেন। তাতে আমাদের ভয় আরো বেড়ে গেল। বুঝতে পারলাম না কী হবে।
বাঘ জালটা ছিড়ে মুক্ত হয়ে আমাদের দিকে চাইলো। আমাদের সবার কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে। আমাদের
কাঁপুনির চোটে গাছটাও কাঁপছিলো। ভাইজান এসে আমাদের আগলে দাড়িয়েছেন। তাতেও আমাদের ভয়
কমছে না। আমাদের দৃষ্টি কেবল বাঘের দিকে। যদি তেড়ে আসে, তাহলে কী হবে?
কিন্তু
বাঘ তেড়ে আসলো না। যে দিক দিয়ে এসেছিলো, সে দিক দিয়েই চলে গেলো গহীন জঙ্গলে।
‘নাও, আর ভয় পাওয়ার দরকার নেই। মাংস খাওয়ানোর কৃতজ্ঞতায়
বাঘ আমাদের কিছু না করেই চলে গেছে।’ ভাইজানের মুখ থেকে এ কথা শুনে হাফ ছাড়লাম।
আমরা
সবাই গাছ ছেড়ে দিয়ে হাঁপাচ্ছি। কেবল বোম এখনো গাছ ধরেই রয়েছে। ব্যাপারটা কী? আমি জানার
জন্য বোমের কাছে গেলাম। ওকে প্রায় গাছ থেকে টেনে আলাদা করলাম। তারপর এমন করার কারন
জিজ্ঞেস করলাম। নেহাৎ আশেপাশে আমি ছাড়া আর কেউ ছিলো না, তাই বোম আমাকে সব খুলে বলল।
যদিও ওর প্যান্ট আর গাছের ছালের ওপর ভেজা ভেজা দেখে ব্যাপারটা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম।
বাড়ি
ফিরলাম। সারাদিন আর কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। রাত্রে হাতমুখ ধুয়েই ঘুম। জানতাম,
ভয়ের চোটে মানুষের ঘুম ধরে না। অথচ আজকের অভিজ্ঞতা দেখে ভয় পেয়ে এমন ঘুম দিয়েছি যে,
রাত কখন পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না।
কালকে
আবার অভিযান দিবস। আমাদের শেষ পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর দিন।
৬
আজকে
যদি ব্যর্থ হয়ে বেঁচে ফিরে, তাহলে আমাদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে ওপর মহলের সাহায্যে কার্যসিদ্ধি
করবেন ভাইজান। কালকের ঘটনায় যে ভয় মনে গেঁথে ছিল, ভাইজানের এ সিদ্ধান্তে তার চেয়ে দ্বিগুণ
সাহস নিয়ে, বেরিয়ে পড়লাম সকালের নাস্তা করে।
পথে
যেতে যেতে কথা হচ্ছিল।
বোম
বলল, ‘আইজক্যা আর বাঘরে ছাড়মু না। এক্কেরে ধইর্যাই ছারমু।’
পেঁপে
ভাইয়া মন্তব্য করলো, ‘মার্কেট থেকে বেছে বেছে মোস্ট স্ট্রংগেস্ট নেটটাই বুই করলাম,
তাও বাঘ সেটা আমাদের সামনে কুটি কুটি করলো। ইশ, নেটটার জন্য মায়া হচ্ছে।’
‘বুই
নয় ভাইয়া, buy, আর মোস্ট স্ট্রংগেস্ট বলতে হয় না।’ ন্যাড়া ফিসফিসিয়ে
বলে।
বোম
বলল, ‘আরেকটু হইলেই বাঘ বাবাজী আমাগোরেই কুটিকুটি করতো, আর তুমি ঐ দুই টাকার জালডার
লাইগা মায়া দেকাচ্ছাও?’
‘বোম,
আমার একটা কথা রাখবি?’
‘কী
কতা? কও।’
‘দ্যাখ,
তোর যেই সাইজে!! তুই যদি খালি একবার বাঘের সাথে কোলাকুলি করিস, নাহলে বাঘের আর মোভে
করার পাওয়ের থাকবে না। থেতলে যাবে। ঐযে, তোর মনে নাই, তোর মামাবাড়িতে গো করার সময় হোয়াট
করেছিলি।’
‘কো,
কী করিছিনু, কওতো।’
বোমের
মনে না থাকলেও, আমার ঠিকই মনে আছে। ওর মামাবাড়ি মনে করে ভুল একটা বাড়ির সামনে আমাদের
দিয়ে গিয়েছিলো, আর নিজের মামা মনে করে সেই বাড়িওয়ালাকে চেপে ধরে থেতলে দিয়েছিলো।
ন্যাড়ার
কথা আবার আমাকে বাস্তবে এনে ফেলল, ‘Move আর Power বাদে বাকিগুলো
ঠিকই বলেছ। আর সত্যিই, বোম ভাই বাঘকে ধরলে তো আর ক-ক-ক-ক-ক-, ধুর, কথাই নেই।’
আমরা আমাদের
গন্তব্যে পৌছালাম। নির্দিষ্ট জায়গায় খাচাটা বসালাম। খাঁচার ভিতর মাংস রেখে বেশ একটা
লোভনীয় পরিবেশ তৈরি করে আমরা গাছে উঠে পড়লাম।
আমি
আর ন্যাড়া এক ডালে, ওদিকে পেঁপে ভাইয়া ও বোম অন্য ডালে। দুর্ভাগ্যবশত, ওদের ডাল একেবারে
খাঁচার উপর। যদি নিচে পড়ে যায়, তাহলে সোজা বাঘের মুখে। এটা ওরা খুব ভালোভাবে জানতো।
কিন্তু জেনেও আমলে নিল না।
ওদিকে
খাঁচার বাইরের দরজা উপরে উঠিয়ে, তার সাথে দড়ি বেঁধে, দড়ির উপর মাথা ধরে ভাইজান বসে
আছেন ঝোপের আড়ালে। বাঘ খাঁচায় ঢুকলে আমরা ইঙ্গিত দেবো, আর ভাইজান দড়ি ছেড়ে দেবেন। খাঁচা
বন্ধ।
আমাদেরকে
বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করিয়ে বাঘমামা দর্শন দিলেন। কালকে হরিণ খেয়ে বেশ মজা পেয়েছেন বলেই
মনে হচ্ছে। আশেপাশে না তাকিয়ে, সোজা একলাফে আমাদের খাঁচার সামনে। চোখের পলক ফেলতেই
খাচার ভেতর ঢুকে মাংস সাবার করা শুরু করে দিলেন।
আমরা
ভাইজান কে ইশারা করলাম। ভাইজান চটপট দড়ি দিলেন ছেড়ে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বাঘ পড়লো আটকা।
এদিকে
বাঘ দেখলো তার যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। তবুও সে বিচলিত হয়নি। ওদিকের দরজায় আঁচড়
কাটতে শুরু করল। এটা দেখে আমাদের উল্লাস, যেটা বাঘকে আটকা পড়তে দেখে বের হতে চাইছিল,
মাঝপথে আটকে গেল। কোন লক্ষ্যবস্তু আলাদা করে নেওয়ার জন্য আমরা যেমন ক্রস চিহ্ন দিয়ে
নিই, বাঘও তাই করছে মনে হয়।
ওদিকে
পেঁপে ভাইয়া আর বোমের সে চিন্তা নেই। ওদের আনন্দ আমাদের মতো আটকে যায় নি। বোম তো নাচতে
শুরু করেছে। মুখে বলছে, ‘ধইরে ফেলাইছি, বাঘ আইটকে গ্যাছে। ওয়ে ডিসকো ডিসকো! ওয়ে ডিসকো
ডিসকো!!!!’
যখন
ওরা গাছের ডালটায় উঠেছিল, তখনই শুনেছিলাম মট করে একটা শব্দ। আর এখন বোমের বিশাল শরীরের তাণ্ডব ডান্স!! ডাল কি আর আস্ত থাকবে? আমরা প্রচণ্ড ভয়ে আছি। চিৎকার দিয়ে বোমকে থামতে বলছি। কিন্তু বোম মনে করেছে আমরা ওকে আরো উৎসাহ দিচ্ছি। ও আরো জোরে জোরে ডান্স শুরু করলো!
ডান্স দিতে দিতে এক পর্যায়ে লাফানো শুরু করলো। ও যদি লাফায়, তাহলে ডালের দুলুনিতে ভাইয়ার
কী হবে? আমরা বোমকে ছেড়ে ভাইয়ার দিকে তাকাই। কিন্তু কই? ভাইয়া তো ডালে নাই!!
নিচে তাকিয়ে দেখি ভাইয়া পড়ে আছে খাঁচার ছাদের উপর।
চিত হয়ে পড়েছে। বাঘ পাশের দরজা ছেড়ে এখন ছাদে, মানে ভাইয়ার নিচে আচড় কাটছে। আর ভাইয়ের
মুখের যে অভিব্যাক্তি, যে এক্সপ্রেশন, তা দেখে হাসবো না কাঁদবো, বুঝতে পারলাম না। বোমকে
বললাম আরো জোরে লাফাতে। বোম থামলো। আমার কথা বুঝতে চাইল। কিন্তু হঠাৎ……।
পা
পিছলে ধপাস!! সোজা ভাইয়ার উপর গিয়ে পড়েছে। আর দুজনের মিলিত চাপে, খাঁচা ভেঙে দুজনেই
বাঘের উপর!!!!!
ছাদের পাতলা কাঠগুলো আর সহ্য করতে পারেনি। পেঁপে ভাইয়া
নেহাৎ লিকলিকে! ওকে সহ্য করে নিয়েছিলো। কিন্তু, বোম? ওকে কী আর……।
আমার নজর সেদিকে নেই। আমি ডালের দিকে তাকিয়ে আছি।
বোমের এত দাবড়ানি খেয়েও বহাল তবিয়তে আছে। বুঝলাম, এ ডাল মচকাবে, কিন্তু ভাঙবে না! আমার
মুখ দিয়ে বের হলো,
বাহ! মিস্টার ডাল,
বদলায়নি আপনার হাল।
এবং বলতে বলতেই আমাদের ডালটা ভেঙে আমি, ন্যাড়া আর
খেপু, তিনজনেই ধপাস! জ্ঞান হারানোর আগে বুঝলাম, তখন যে মট করে আওয়াজটা শুনেছিলাম, সেটা
বোমদের নয়, বরং আমাদের ডালের ছিলো।
আর কিছুই মনে নেই।
জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি ভাইজান এর বাসায় সোফায় বসে আছি।
পরের ঘটনা ভাবিজানের মুখ থেকে শোনা। পেঁপে ভাইয়া আর
বোম বাঘের ঠিক ওপরে পড়েনি, বাঘের পাশে গিয়ে পড়েছে। বাঘের ওপর পড়লে বাঘ নির্ঘাত পটল
তুলতো। তবে পড়ামাত্রই বোমসাহেব বাঘকে ধরেছেন জাপটে। বাঘ আর নড়তে পারে না।
ভাইজান ফোন করে বাঘ ধরা পড়ার খবর দেন। লোকজন আসে।
বাঘকে নিয়ে আগের জায়গায় রেখে আসে। তবে তারা আসার আগ পর্যন্ত বোম বাঘকে ধরে রেখেছিলো।
বাঘ ধরার কৃতিত্ব পুরোটা দেওয়া হয়েছে পেঁপে ভাইয়া
আর বোমকে। ভাইয়ের উপর বোম পড়তে ভাইয়ার কোমর ভেঙেছে। কিছুদিন হয়তো হাসপাতালে কাটাতে
হবে, কিন্তু কৃতিত্ব পেয়ে বেশ খুশি। বোমের কিছু হয়নি। ও উপুর হয়ে পড়েছিলো। তাতে
ওর গগনচুম্বী ভূড়ি ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
আর
আমি? আমি না বললে তো বোম নিজের ডান্স থামাতোও না, নিচে পড়তোও না, আর বাঘও ধরা পড়তো
না। তাই কৃতিত্ব হিসেবে আমারই প্রাপ্য। তবে পাইনি বলে দুঃখ নেই। প্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরতে
পারব, ইয়েহি মেরে লিয়ে কাফি হ্যায়, কোয়ি শক!
কাহিনী শেষ

