১
বর্ষার দিন। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে গ্রীষ্মের ছুটি।
হাতে কোনো কাজ নেই। প্রথম সাময়িক পরীক্ষাও শেষ। তাই পড়াশোনার চাপ নেই বললেই চলে।
সকাল সাতটা বেজে গেছে।
রোজ এই সময় আহমেদ ভাইয়ের চা পেটে না পড়লে পুরো দিনটাই মাটি। বৃষ্টি থামে নি। কিন্তু
কমে গেছে অনেকটা। ছাতা দিয়ে চলে গেলাম দোকানে। বৃষ্টি বলে লোকজনের আনাগোনা কম। কিন্তু
আমাদের বাহিনীর বাকিগুলো আমার আগেই এসে বসে আছে। আমি পৌঁছতেই পেঁপে ভাইয়ার লম্বা-চওড়া
ভাষণ শুরু হলো, Ôঐ দ্যাখ, নবাবপুত্র নসু এদিকেই কাম (come) করছে। কিরে নসু, টুডে
এত লেট? হোয়াই?
Ôআর বোলোনা গো পেঁপে ভাইয়া, কাল রাতে ম্যায় তো......।' ন্যাড়া আমার কথা
লুফে নিয়ে বলল, Ôতু-তু-তু-তুমি ভালু আর জেঞ্জার কালু উপন্যাসটা পড়ছিলে রাত জে-জে-জেগে।
তা-তা-তাই ঘুম থেকে উঠতে দে-দে-দে-দেরী হয়ে গেছে।'
Ôতুই তো বিলকুল সাহি বলেছিস। লিকিন তুই কীভাবে জানতে পারলি কি মেরে পাস......
মানে আমার কাছে বইটা আছে?'
ইতোমধ্যে খেপুর উত্তর, Ôতুমি গত কল্য লাইব্রেরী হইতে বইটি খরিদ করিয়াছিলে। আমি আর ন্যাড়াদা দেখিয়াছি।
Ôগোয়েন্দাগিরি শুরু কিয়াহ্যা?'
Ôতা ব-ব-ব-বলতে পারো।'
পেঁপে ভাইয়া জিজ্ঞাসা
করলো, Ôতা তোদের
স্খুল কী রিজনে অফ হয়েছে। স্খুল অফ হওয়ার বেহিন্ডে তো কোনো রিজন দেখি না!'
ন্যাড়া ঠিক করে দেয়, Ôস্খুল নয়, school বলো।'
Ôযেই থালায় খাস, সেই থালায় ডিগ করিস (Digg = গর্ত)? ইনসুল্ট, ইনসুল্ট!!
স্খুলে শিখালো C তে যদি ক হয়, তাহলে ch লিখলে খ হবে। স্খুল বানানে ch আছে
কিনা বল।'
Ôইনসুল্ট নয়, insult।'
Ôনে, শুরু হয়ে গেলো। একটু ইংরেজি পিক করতে না করতেই যেন তোদের হাপানি বিগেন
হয়।'
খেপু কান নিজের কাজ শুরু
করে দিয়েছে। ও বলল, Ôলিক?? ইংরেজি লিক করিয়াছ। ইংরেজি কি সাইকেলের চাকার পাইপ নাকি, যে লিক
হইবে।'
আমি উত্তর দিলাম, Ôআরে সাইকেলের চাকার পাইপ নয়, ওই জিনিসটাকে
টায়ার বলে।'
Ôওই হইলো একটা! যাহা হউক, পাইপ হউক বা টাইয়ার, কিন্তু ওই বস্তুটির সহিত
ইংরেজির তো যথেচ্ছ পার্থক্য বিদ্যমান রহিয়াছে। তাহা হইলে ইংরেজি লিক কীভাবে হইবে?'
এবার ন্যাড়া বলে, Ôনা রে, লি-লি-লি-লিক না। ভাইয়া speak বলতে
চেয়েছিলো। কিন্তু জিহবা উল্টে গিয়ে 'দ-দ-দন্ত স' মিস হয়ে গেছে। তাই পিক বেড়িয়ে গেছে।'
বোম এতক্ষণ পর কথা বলল।
বলল, Ôএতক্ষন
ধইর্যা তোমাগো কতা শুনতাছি। এইব্যার আমার কতা শুনো। আমি একখান কামের কতা কই। কতাডা
হচ্চে বৃষ্টির দিনে গ্রীষ্মের ছুটি দিলো ক্যা? বৃষ্টির দিন তো বর্ষার ছুটি দেওন উচিত।
তাই ন্যা??'
আমি বললাম, Ôতাজা একটা প্রশ্ন করেছিস। কিন্তু আসল
ব্যাপারটা হচ্ছে, প্রতিবছর এই সময় গ্রীষ্মকাল থাকে, তাই গ্রীষ্মের ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু
এইবার, না শুধু এইবার না, গত কয়েক বছর হতে বর্ষাকাল এগিয়ে আসছে। এইবার মারাত্মকভাবে
আরো তাড়াতাড়ি শুরু হোগ্যায়া!'
পেঁপে ভাইয়া জানালো গ্লোবাল
ওয়ার্মিং এর কথা। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই গ্লোবাল ওয়ার্মিং না বলে ডবল ওয়ার্নিং বলে
দিয়েছে!'
খেপু বলল, Ôসত্যবচন!! ইহা সৃজনের জন্য দায়ী হইতেছে
এই মনুষ্যজাতি। ইহা বন্ধ হইতে হইবে।'
ন্যাড়া একটু গর্ব সহকারে
বলল, Ôআমি
তো ঠিক ক-ক-ক-করেছি জীবনেও বাইক চালাবো না। কোথাও যেতে চাইলে সাইকেলে করে যা-যা-যাবো।'
পেঁপে ভাইয়া জিজ্ঞাসা
করলো, Ôসাইকেলে
যাবি কেন? তোর কাছে লেজ নাই? '
বোম হাঁ হয়ে গেছে। ওর
মাথায় ঢুকছে না যে ন্যাড়া লেজ দিয়ে হাঁটবে কীভাবে? ন্যাড়া শেষে শুধরে দিলো। বলল, Ôতোমরা কি ভুলে গেছ যে আমাদের ভা-ভা-ভাইয়া
G এর
উচ্চারণে কক্ষনো 'গ' বলে না। স-স-স-সবসময় 'জ' দিয়ে বলে। তাই ভাইয়া আসলে লেজ বলতে, Leg বুঝিয়েছে।'
পেঁপে ভাইয়া বলল, Ôজি এর উচ্চারণ যে কেন গ দিয়ে করে,
আমি জানি না। আমি কোনোদিন করব না। হান্ডেড পারসেন্ট সুরে (100% sure)।'
আমি ভাইয়াকে বললাম, Ôতোমাদের মতো ইনসানরাই পারবে এই ধারতিকো
বাঁচাতে।'
আমার কথা শেষ হতে না হতেই
দেখা গেলো একটা চোর ছুটে আসছে ব্যাগ নিয়ে। পেছনে ধাওয়া করেছে পুলিশ। চোরটা আমাদের পাশ
দিয়ে চলে গেলো। দৌড়াতে লাগলো খুব জোরে। পুলিশও তার কয়েকজন সেপাই নিয়ে চোরের মতো গতিতে
দৌড়ে চোরটাকে ধরার চেষ্টা করছে। আমরা তো বসে বসে কীর্তি দেখছি। সবারই মনে হচ্ছিলো যেন
আমরা গিয়েই চোরটাকে ধরিয়ে দিই। বোম শুধু একবার বলে উঠলো, Ôআরে করো কী, করো কী? সবকয়জন বইস্যা
আছাও ক্যা? চলো, চোরডারে ধরায়্যা দিই। তাইলে মানষের মদ্দে পরিচিত হওন যাইবো।'
বোম কথা শেষ করতে পেরেছে
কিনা, আমরা সবাই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। পেঁপে ভাইয়া বলতে লাগল, Ôঅন ইয়োর মার্কস। রেডি, শেডি!!!'
Ôআরে ভাইয়া, শেডি না, স্টেডি!!'
Ôনো.......।'
Ôআরে ভাইয়া, নো নয়। গো বলনা পারেগা।'
Ôআরে, আমি ন্যাড়াকে আমার ইংলিশে নোজ মিক্সার করতে ফরব্যাড করছিলাম। আমি
মোটেও গো বলার ট্রাই করিনি।'
Ôতোমরা কি খালি প্যাঁচাল-ই পাইরা যাবে, নাকি কামের কামডাও করবে?'
আমরা যেই দৌড় শুরু করব,
দেখি পুলিশগুলো চলে আসছে আমাদের দিকে। আমরা তো অবাক। এই একটু আগে চোরটা পুলিশের চেয়ে
৬.০৫ মিটার এগিয়ে ছিলো (পাকা হিসেব), আর মাত্র ১৪.৯৭ সেকেন্ডে চোরটাকে পাকড়াও করে পুলিশটা
ফিরে আসছে। আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলো গটগট করে। আমরা ঘুরে দাঁড়ালাম পুলিশের দিকে
মুখ করে। একদৃষ্টে দেখছি চোরটাকে। দু-চারটে কষে মার পড়েছে।
আমাদের ঘাড়ে কে যেন হাত
দিল। আমরা পিছনে ফিরলাম। দেখি তিনজন ছেলে। বয়সটা আমাদের মতই। কিন্তু দেহটা আমাদের তুলনায়
বেশ উন্নত। জিম করা বডি মনে হয়। কিন্তু তিন নাম্বারটা প্রায় বোমের মতো। ওদের নাম ছিলো
জনি, ননি আর ব্যাস।
জনি প্রথম মুখ খুলল। সে
বলল, Ôআরে,
তোমরা তো আজব দেখছি। আরে তোমাদের পাশ দিয়ে চোরটা পালালো, আর তোমরা ধরতে গেলে না। আরে
তোমাদের মত ছেলেদের জন্যই তো আমাদের মাঠে নামতে হয়।'
খেপু মিনমিনিয়ে জিজ্ঞেস
করে, Ôআপনারা
কারা? আপনাদেরকে তো কখনো এই পাড়াতে পূর্বে দর্শন করি নাই!!'
Ôদেখো, গুরুচণ্ডাল, এটা দ্বিতীয় সদস্য, অর্থাৎ ননি বলেছে।'
ব্যাস নামক ছেলেটি দেখি
সব কথা-ই ব্যাস শব্দটা দিয়ে শুরু করে। বলল, Ôব্যাস, অনেক হয়েছে। ওরা আমাদের পরিচয় চেয়েছে, আমরা পরিচয় দেব। শোনরে ছোকড়াগণ,
নিজের কানে ঠিকমতো ঢুকিয়ে নে।
আমরা টিম বিষ
দিই শিস
খাই ফিশ
মারি ঢিশ
মার খেয়ে বলবি ইশ
ইশ ইশ
শুনে আমরা হাসছিলাম। ন্যাড়া
জিজ্ঞেস করলো, Ôআপনারা
কি ক-ক-ক-কবি কমিটি?'
ননি বলল, Ôদেখো, এ তোতলা বলে কী! দেখো, শুনে
নাও, আমরা কোনো কবি কমিটি না। ওটা ছিলো আমাদের পরিচয় সংগীত।'
Ôএবার তোমরা ওর (খেপুর) কুয়েশ্চনের রিপ্লে দাও,' পেঁপে ভাইয়া বলল।
ন্যাড়া ফিসফিসিয়ে বলল,
ÔReply, Reply।'
Ôআরে এটা তো দেখি অশুদ্ধ ইংরেজ। তবে যাই হোক, শোন সবাই। আমরা এই পাড়ায় নতুন
এসেছি। আরে কয়েকদিনের মধ্যেই এই এলাকার রাজা হয়ে যাবো। তোমাদের দাওয়াত থাকলো।'
আমি আর চুপ করে থাকলাম
না। গদি নিয়ে টানাটানি না হয়ে পুরো দখল হওয়ার চেষ্টা চলছে, আর আমি চুপ করে থাকবো? কভি
নেহি! বলে উঠলাম, Ôআমরা এখানকার রাজা, বুঝলে? রাজার ওপর রাজাগিরি করতে এসো না। হামকো হাঁটা
সাকে, তুমলোগোমে দাম নেহি; তুম হামছে ডারোগে, তুমলোগোসে হাম নেহি।'
Ôব্যাস, বেশি কথা বললে প্যান্ট খুলে গাছের মগডালে বেধে রেখে আসবো।'
আমি তো রেগে কাই। চিৎকার
দিয়ে উঠলাম, Ôঐ,
তোর এত বড় সাহস।'
ব্যাস আর আমার মধ্যে মারপিট
হয়েই যেত। কিন্তু বোম আমাদের থামিয়ে মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। তারপর বলল, Ôখাড়াও, খাড়াও। মারামারি পরে কইরোনি।
আগে কও, ব্যাস বাবাজী, কোন জিনিসডারে বাইন্ধা আসবা? প্যান্ট রে, নাকি প্যান্টের মালিক
রে? '
Ôব্যাস, দাঁড়া। এখনই দেখাচ্ছি।'
এই বলে ব্যাস গেলো বোমকে
তুলতে। দুই মটুতে যুদ্ধ!! কিন্তু যতই আঁচড়-পাঁচড় করুক, বোমকে এক চুল নড়াতেও পারলো না।
উপরে তোলা তো দূরে থাক!! বোম মিটমিটিয়ে হাসছে। বলল, Ôযত পারো জিম কইর্যা বডি বানায়া আসোগা,
আমারে চ্যাতানের লাকান শক্তি পাবে নানি।
ব্যাস হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে
হাঁপাতে বলল, Ôকী
খাস রে ভাই? '
Ôএখন ভা-ভা-ভাই বলছ কেন। শ-শ-শ-শক্তি থাকলে ওকে উঁচিয়ে দেখাও।'
Ôব্যাস, অনেক হয়েছে। শোন রে, তোকে তো আমি তুলবই। দরকার হলে বুলডোজার আর
রোড রোলার দুইটাই নিয়ে আসব।'
পেঁপে ভাইয়া বলল, Ôএই মরকট দেখছি নাথিং কনো (know) করে।
আরে হেভি থিং লিফট করতে হলে বুলডোজার নয়, আনতে হয় ক্রেন।'
Ôসব ক্রেন গুলারে উলটাইয়া দিবনি। দেখপনি, ক্রেনের গায়ে বেশি শক্তি, নাকি
আমার গায়ে,' এই কথাগুলো বোম বলে দিলো তেজ সহকারে।
খেপু বলল, Ôঐ ভারী বস্তু তুলিবার যন্ত্র যদি বোমদার
সহিত লাগিয়ে আসে তো কুরুক্ষেত্র হইয়া যাবে।'
জনি কেমন যেন একটা স্টাইল
নিলো শাসানোর। শাসানো হয়ে গেলে বলল, Ôআরে, আজ তোমাদের কিছু বললাম না। কিন্তু আমরাও দেখবো, তোমরা কিভাবে এখানে
নিজেদের দাদাগিরি চালাও।'
এই বলে টিম বিষ আমাদের
সামনে থেকে প্রস্থান করলো। ওরা আজ কিছু করেনি। তাই আমরাও আজ কিছু করব না। ভাবতে শুরু
করেছি। এবার কি করবো? সবাই ভাবছে। ভাবতে ভাবতেই আমরা চায়ের দোকানে এসে বসলাম।
২
দিন কয়েকের মধ্যে টিম বিষ তাদের কথা রাখতে শুরু
করল।
সত্যিই আমাদের এলাকায়
দাদাগিরি করার পূর্বাভাস পাওয়া গেল। দলনেতা জনির খুব বুদ্ধি। প্রথমেই হাত করেছে আমাদের
এলাকার ইনস্পেক্টর জনাব কুতশীত কে।
এখানে বলে রাখা দরকার
একটা কথা। এটা ভাববেন না যে ইন্সপেক্টর দেখতে কুৎসিত বলে তার নাম কুতশীত। তিনি দেখতে
মোটেও কুৎসিত নন। আসল ব্যাপারটা হলো, তার নামের পেছনে রহস্য আছে। রহস্যটা অবশ্য কানাঘুষা
শোনা।
Òআমাদের এই জনাবের নাকি জন্মের তিন বছরে কোন নামই ছিল না। সবাই ডাকতো অজানা
বলে। তখন জনাব কুতশীতের একটা গুণ সবার চোখে পড়ে। সেটি হচ্ছে, জনাব কুতকুত খেলতে বেশ
পছন্দ করতেন। বিশেষ করে শীতকালে, ৯.৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, যেখানে অন্যান্য
বাচ্চারা জুতা-মোজা-সোয়েটার-প্যান্ট-মাংকি টুপি ইত্যাদি ইত্যাদি ছাড়া বাইরেই বের হতে
পারতো না, সেখানে আমাদের জনাব খালি গায়ে, খালি পায়ে ঠান্ডা মাটির ওপর দাঁড়িয়ে কুতকুত
খেলতেন। আর এর জন্যে যে জনাবের কোনোদিন নিউমোনিয়া হয়েছে, তা কোনোদিন শোনা যায় নি। তার
এই গুণ সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলো। সবাই মিলে তার নাম ঠিক করে দিয়েছিল,
শীতকাল-কুতকুত [শর্তমতে]
= শীত-কুত [কাল ও কুত বর্জন করে]
= কুত-শীত [ব্যস্তকরণ করে] (প্রমাণিত)
একেবারে সেই ধাঁচের পুলিশ
তিনি। একটা পুলিশের ভেতরে যে রকম বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত, তার সবই ছিলো তাঁর মধ্যে। তাঁকে
হাত করতে পারলেই যেন আমাদের এলাকার অর্ধেকটা রাজ করা যেত। কত চেষ্টা করেছি ওনাকে নিজের
বশে আনতে!! কিন্তু পারিনি। কিন্তু কিছুদিন ধরে চেষ্টা করতে করতেই টিম বিষ ইনস্পেকটর
সাহেবকে হাত করে নিয়েছে।“
তাকে বশ করার গল্পটা শুনেছিলাম
আমাদের এক গোপন সোর্সের কাছে।
Òজনাব কুতশীত বের হয়েছেন প্রাতভ্রমণে। যদিও তাঁর শরীর সবসময় চাঙ্গা থাকে,
তবুও তিনি প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হন। এমনও হয়েছে যে, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই
তাঁকে রাস্তায় দেখা গেছে। টর্চলাইট হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। যাই হোক, সেদিনও তিনি হাঁটতে
বের হয়েছেন। যখন তিনি একটা রাস্তা পার হতে যান, তখনই সামনে থেকে আসছিলো একটা ট্রাক।
জনাব কুতশীত সামনে, তবুও ট্রাক থামছে না। তিনি রাস্তার একেবারে মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন।
ভাবছেন বামে সরবেন, না কি ডানে সরবেন। ট্রাকটা একেবারে তার সামনে এসে গেছে। আর দুই-এক
সেকেন্ডেই জনাবের ভর্তা হতে চলেছে। ঠিক তখনই ছুটে আসে জনি। এক ধাক্কায় ঠেলে দূরে সরিয়ে
দেয়............।
না, না, জনাব কুতশীতকে
নয়, আস্ত ট্রাকটিকে!!! জনির এক ধাক্কাতেই ট্রাকের দিক পরিবর্তন হয়ে যায়!!!
এতে কী প্রমাণ হলো? জনির
গায়ে হাতির মতো জোর? আপাতদৃষ্টিতে তা-ই মনে হতে পারে, কিন্তু ভেতরে গড়বড় ছিলো। ব্যাপারটা
একটা সহজ কারসাজি ছাড়া আর কিছুই না। কথা হচ্ছে এইটা যে ড্রাইভারের সিটে বসে ছিলো স্বয়ং
ব্যাস। জনাবের ঠিক সামনে গিয়ে কেবল স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে দিয়েছে সে। আর জনি কেবল ট্রাকটিকে
ছুঁয়ে দিয়েছে। এতেই মনে হয়েছে যে জনি গায়ের জোরে ট্রাক ঠেলে ট্রাকের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে।
তবে হ্যাঁ, CID থেকে
শুনেছি, অপরাধী (আমাদের ক্ষেত্রে টোকাই ছেলেপেলে) যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, অপরাধ
করার সময় কোনো না কোনো একটা ভুল সে করবেই। এরাও তা-ই করেছে। জনার কুতশীত সম্পর্কে স্বরে-অ
থেকে চন্দ্রবিন্দু (A to Z) না জেনেই ওরা এইরকম একটা মারাত্মক কাজ করতে গেছে। আসলে কুতশীত সাহেবের
চোখের পাওয়ার সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিলো না। সেই কারণে মাস্ক-টাস্ক কিছু না পরেই
ট্রাক চালিয়েছে ব্যাস। ভেবেছে হয়তো জনাব ওকে দেখতে পাবেন না। কিন্তু যে পুলিশের চোখ
মাস্ক ভেদ করে চোরের মুখ পর্যন্ত চলে যায়, তাঁর জন্য কি ট্রাকের কাচ ভেদ করে ভেতরে
বসা ড্রাইভারের মুখ দেখা খুবই কঠিন?
একেবারেই কঠিন নয়। বরং
খুবই সহজ। হয়েছিলোও তাই। এক্সিডেন্টের আতঙ্ক থাকলেও জনাব দেখে নিয়েছিলেন ব্যাসের চেহারা।
জনি তাঁকে বাঁচানোর পরে তিনি নাকি ট্রাকের পেছন পেছন দৌড়েছিলেন। কিন্তু ধরতে পারেন
নি। তবে উঁচু গলায় শাসিয়েছিলেন, Ôতোকে দেখে নিয়েছি রে ড্রাইভার। তোকে তো আমি ধরবোই, তা ১০ মিনিট পরেই হোক,
আর ১০ বছর পরেই হোক, তোকে আমি ধরবোই।'
তাই ব্যাস আর জনাবের সামনে
আসে না। জনি আর ননি-ই তাঁর মোসাহেবি করে।“
কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের
পাড়াতে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করলো টিম বিষ। কুতশীত সাহেবের সাথে এখানে ওখানে যাবে,
মিছিল মিটিং করবে, কোনো অনুষ্টানে স্বেচ্ছাসেবির নাম নিয়ে জনগণকে পেটানো শুরু করবে
ইত্যাদি ইত্যাদি। জনি আর জনি যেন জনাবের ডানহাত আর বামহাত হয়ে গেছে। অপরাধী ধরতেও সাহায্য
করেছিলো কয়েকবার। সবার আগে আমাদের সামনে দিয়ে যে চোরটাকে ধরলো, সেইটার খবর আগে দিয়েছে
জনাবকে। সত্যিই আমাদের এলাকাকে নিজেদের এলাকা বানাতে শুরু করেছে। আহমদ ভাইয়ের দোকানে
একুশবার এসে ভরপেট নাস্তা করে গেছে, তাও একেবারে বিনামূল্যে। টাকা চাইতে গেলেই কুতশীত
সাহেবের নাম নেয়।
কেউ কিছু বলতে সাহস পায়না
ওদের। একে তো ওদের অভিজ্ঞতা আছে, তারপর আবার পুলিশের ঘরের দুলাল। পাড়ার ডন না হয়ে আর
যায় কোথায়? একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে সেটা ওদের দাদাগিরির প্রত্যক্ষ প্রমাণ বহন করে।
Òনতুন একটা ক্লাব গঠন করা হয়েছে আমাদের এলাকায়। নাম দেওয়া হয়েছে Òজিন্দাপুরুষ“। সভাপতি নিয়োগ করা হয়েছে
জনাব কুতশীতকে। উদ্বোধনের দিন তিনি ফিতা কেটে ক্লাবের শুরু করবেন। কিন্তু দরকারি মিটিংয়ে
আটকে গেলেন ঐ দিন। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো যে এলাকার মেম্বার জুবায়ের সাহেবকে দিয়ে
উদ্বোধন করানো হবে। মেম্বার সাহেব কেচি নিয়ে তৈরি। যেই না ফিতা ছুঁয়েছেন, তাঁর হাত
আটকে ধরে ননি। আর সেই সময় তাঁর হাত থেকে কেচি একেবারে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে জনি নিজে ফিতা
কেটে দিলো। এলাকার কেউ, এমনকি মেম্বার সাহেব নিজেও এর প্রতিবাদ করার সাহস পেলেন না।“
আমরা অনেকদিন চুপ ছিলাম।
কিন্তু ২১ নম্বর দিন আহমদ ভাই যখন ওদের কাছে নাস্তার টাকা চাইতে গেলো, তখন ওরা এমন
ব্যবহার করলো, আমাদের আর সহ্য হলো না। আমি রেগে উঠে তখনই গিয়ে দু-চারটে লাগিয়ে দিবো,
এমন সময় ন্যাড়া আমাকে চেপে ধরলো। হয়তো ও বুঝতে পেরেছিলো যে, ওদের কাছে গেলে আমার হাসপাতালে
ভর্তি হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না।
আমি প্রচন্ড রেগে উঠেছি।
এবার ওদের ডানা কাটতেই হবে। নিজ মুলুকে দাদাগিরি আমরা চালাবো। ওরা কোথায় থেকে আসে?
রাগ দেখালাম ন্যাড়ার ওপর, Ôআমার হাত ধরলি কেন?'
Ôএখন তো-তো-তো-তোমার হাত না ধরলে কয়েকদিনের জন্য তুমি আমাদের চো-চো-চোখের
আড়াল হয়ে যেতে। তাহলে আমাদেরই সমস্যা হতো প-প-প-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে।'
Ôকিসের পরিকল্পনা?'
Ôকা-কা-কা-কালকে বলবো।'
আগামীকাল আসতে না আসতেই
আমাদের কাছে একটা খবর চলে এলো। জুবায়ের সাহেব নাকি একটা গোপন মিটিং ডেকেছেন। লোকজনের
ভিড়ে মিশে আমরাও ঐ মিটিংয়ে গেলাম। আলোচনা শুনে যেটা বুঝলাম তাতে এটা বলা যায় যে জুবায়ের
সাহেব প্রচন্ড খেপে আছেন। তবে এটাও বুঝলাম যে এখানকার কোনো লোকের পক্ষেই কাজটা সম্ভব
হবে না, এরা যা বস্তাপচা বুদ্ধি দিচ্ছে!!!
সুতরাং যা করার আমাদেরই
করতে হবে।
৩
পরের দিন আহমদ ভাইয়ের
চায়ের দোকানে এসে হাজির হলাম সবাই। আজকে একটা পাকাপোক্ত পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। আমাদের
আলোচনাটা ছিলো মোটামোটি এরকম।
পেঁপে
ভাইয়া: তাহলে কী ডেসিটিওন নিলি? আমি তো আর
থিংক করতে পারছি না।
ন্যাড়া: ডেসিটিওন নয়, কথাটা হচ্ছে ডিসিশন।
বোম: এরা যে সব কাজকাম শুরু করছে, সেগুলা সরাসরি যায়া কুতশীতরে খুইল্ল্যা কইলেই
তো হয়। এতে এতো ভাবা লাগবি ক্যা?
আমি: সরাসরি বলে দিলে কাহিনী উলটো হয়ে যাবে। তখন আমাদেরই জেল মে ঘুসনা পাড়েগা।
খেপু: তাহা হইলে কী করা যাইবে? আমি যাহা সম্ভব করিবার নিমিত্ত তৈয়ার রহিয়াছি।
তোমরা বলিবে, আমি করিব।
আমি: ন্যাড়া, তুই কালকে কী একটা পরিকল্পনার কথা বলেছিলি?
ন্যাড়া: ভুলে গেছি নসু ভা-ভা-ভাই। এত বড় একটা প্যা-প্ল্যা-প্ল্যান করছিলাম যে,
খাতায় লিখে রাখা উচিত ছিলো। কে জা-জা-জা-জানতো ভুলে যাবো।
বোম: কিন্তু স্যার রে সব বুঝায়া কইলে হবিডা কী শুনি? আমরা যায়া স্যারেক সব
কবো। এরা কী কী আকাম করছে। আমারে এই ভাইডার একটা টেকাও দেয় নি। ফিরি ফিরি নাস্তা করছে।
মেম্বারের হাত থাইক্যা কেচি কাইড়্যা নিছে। এগুলো কইলেই তো কাম হয়্যা যাবি।
আমি: এগুলো উদাহরণ যদি কুতশীত সাহেবের সামনে খাড়া করিস, তাহলে আমরা ইন্ডাইরেক্টলি
দেখিয়ে দেবো যে স্যার ভুল কিয়াহ্যা। আর স্যারের ভুল ধরার মানে জানিস কি তোরা?
বোম: কেজান!!
খেপু: আমি জানি। কুতশীত মশাইয়ের ভুল ধরিবার অর্থ হইতেছে আইক্যা-সংযুক্ত বাঁশ নিজেদের
পশ্চাৎদেশে গ্রহণ করা। ঠিক বলিলাম কিনা?
ন্যাড়া: তুই কী বাঁশ এর সাধুভাষা জানি না?
পেঁপে
ভাইয়া: আর রাখ তোদের উগলাই কাহিনী। শোন,
ইউনাইটেড ব্যাম্বু নিজের ব্যাকপার্ট এ টেক করার কোনো ইনটেনসিওন নেই আমার।
ন্যাড়া: প্রথমটা ugly, তারপর united
bamboo, তারপর intension, ভেরি না-না-না-নাইস।
বোম: ত্যালে কী করণ যায় কও।
আমি: আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে।
সকলে
একসাথে: কী?
আমি: শোন সবাই, কোয়ি নাহি জানতা ব্যাস ইনস্পেকটর সাহেবের শত্রু। তাই এই সহজ
বুদ্ধিটা কারো মাথায় আসেনি। আর তাই, আমরা যদি কোনোভাবে.........।
পেঁপে
ভাইয়া: উই যদি এনি উপায়ে ব্যাসকে কুতশীতের
সামনে ব্রিং করতে পারি, তাহলেই ফোর্ট ফতে!!!!
বোম: বুইজ্জা ফালাইছি। কিন্তু ফোর্ট ফতে মানে কী?
ন্যাড়া: ফোর্ট মানে কেল্লা, আর ফতে মানে ফতে। মোট মিলিয়ে কেল্লা ফতে!!!
খেপু:
চিল্লা? আমি চিল্লাইবো কেন? আমার চিল্লাইতে মন
চাহিতেছে না।
আমি:
চিল্লা নয় রে, কেল্লা বলেছে।
খেপু:
জ্বলেছে? কে জ্বলিয়াছে? আগুন কোথায় লাগিলো?
ন্যাড়া:
এ তু-তু-তু-তুই থাম।
খেপু:
পাম? কী সব বলিতেছ? আমরা চায়ের দোকানে বসিয়া আছি।
সাইকেলের গ্যারেজে না। এইখানে পাম কোথায় মিলিবে?
(এবার পেঁপে ভাইয়া চেঁচিয়ে উঠলো। মাটি
কাপানো চিৎকার।
সবাই চুপ। নেতার গলায় জোর আছে বলতে
হবে।)
পেঁপে
ভাইয়া: আর কোনো অপোজিট চেঞ্জ কথাবার্তা লিসটেন
(listen) করব
না। প্লেন রেডি। যে ভাবেই হোক, ব্যাস কে কুতশীতের সামনে আনতে হবে। ইজ দ্যাট কিলিয়ার??
ন্যাড়া: অপোজিট মানে উল্টা, আর চেঞ্জ শব্দটাকে যদি আমরা তুই করে ইম্পারেটিভ সেনটেন্স
এ রূপান্তর করি, তাহলে অর্থ হবে পরিবর্তন কর অথবা “পাল্টা“। মোট মি-মি-মি-মিলিয়ে উল্টাপাল্টা।
ওয়াহ, পেঁপে ভাইয়া। তোমার মতো জিনিয়াস আমি দুইটা দে-দে-দে-দেখি নি।
(এবার পেঁপে ভাইয়া নির্ঘাত এক থাপ্পড়ে
ন্যাড়ার গাল এর খাল তুলে লাল করে দিতো।
কিন্তু তাকে জিনিয়াস বলাতে তার হুংকারটা
একটু মিলিয়ে গিয়ে নরম হয়ে গেলো।)
পেঁপে
ভাইয়া: তোকে কি বলা হয়েছে আমার কথাগুলোর অর্থের
ব্রিফ ডেসকিরিপশন দে? বলেছি তোকে?
ন্যাড়া: না-মানে-আমি আসলে......।
পেঁপে
ভাইয়া: আমার মতো জিনিয়াসরাই কেবল আমার কথা
বুঝতে পারে। তাই আগে আমার মতো হয়ে দেখা সবাই। তাহলে করতে পারবি আমার কথার প্রতিটা শব্দ
আন্ডারপ্যা----।
ন্যাড়া:
স্ট্যান্ড, স্ট্যান্ড, আন্ডারস্ট্যান্ড!!!
পেঁপে
ভাইয়া: আগাইন (again).........।
ন্যাড়া: আসলে ভাইয়া, তোমার ক-ক-ক-কথাগুলো শোনার পর সবাই এমনভাবে ফ্যা-ফ্যা-ল-ফ্যা---
ল করে তাকিয়ে থাকে যে মনে হয়......।
পেঁপে
ভাইয়া: মনে হয় যে ভাইয়ার কথার ফুট টু ফুট
ডিকটিওনারি হাজির করি।
ন্যাড়া: কথাটা হবে ডিকশনারি।
আমি:
ভাইয়া এক জিনিয়াস হ্যায়!! ভাইয়া যা বলেছে। সেটাই
সাহি, বাকি সব গালাত!!
পেঁপে ভাইয়াকে আবার জিনিয়াস
বলাতে তাঁর মুখের ওপর থেকে রাগের চিহ্ন একেবারে মুছে গেলো। দেখা গেলো মিটিমিটি হাসি।
শয়তানি হাসি। আর কথা না বাড়িয়ে ভাইয়া ব্যাসকে নাগালে আনার জন্য, তাঁর সদ্য পাকানো খেয়ালি
পোলাও আমাদের সবার কানে বিতরণ করতে লাগলো।
৪
কয়েকদিন পরে ইনস্পেক্টর সাহেবের মেয়ের জন্মদিন।
ওইটাকে কেন্দ্র করেই আমাদের
প্ল্যান। জন্মদিন উদযাপন করার জন্য জনাব নিশ্চয়ই কোনো বড় পার্টির আয়োজন করবেন। আর সেইদিনই
আমরা ব্যাসকে নিয়ে হাজির হবো। আমরা তাই সবসময় টিম বিষ আর জনাব কুতশীতের পেছনে লেগে
থাকি। কখন কী হচ্ছে তাঁর সব খবর নিতে লাগলাম সন্তর্পনে।
একদিন আমাদের সুদিন এলো।
আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম যেদিন কথাগুলো শুনলাম।
Ôজনি, তোমাদের গ্রুপের ৩য় জনকে কিন্তু এখনো আমার সাথে পরিচয় করাও নি।'
Ôস্যার, ৩য় জন? মানে?'
Ôএত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে? সেদিন যে ননিকে বলছিলে? আমি শুনেছি। তা, ব্যাস
কে আমার সামনে কবে আনছ?'
Ôস্যার, নামটাও জেনে ফেলেছেন?'
Ôহ্যাঁ। তাহলে একটা কাজ করো। আমার মেয়ের জন্মদিন। এই তো সামনে। ভেবেছি একটা
বিশাল পার্টি দেবো। সেদিনকেই ওকে নিয়ে এসো।'
Ôজ্বী, আচ্ছা।'
জনি আর ননির মুখ দেখে
যেটা বোঝা গেলো তাতে পরিষ্কার যে ওদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তে চলেছে। হঠাত আবার ননির
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মনে হয় কোনো একটা বুদ্ধি পেয়েছে। জনির কানে কানে কী যেন একটা
বলল। আমরা কেবল এটুকু শুনলাম, Ôওদের দলের মোটাটাকে যদি.....।'
ন্যাড়ার অনুমান যদি সত্যি
হয় তাহলে ওরা যে দলটার কথা বলল, সেটা আমাদের দল। আর মোটা বলে বোম কে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
যদি এইটা সত্য হয়, তাহলে আমাদের পরিকল্পনা একটু পরিবর্তন করতে হবে। তবে আমাদেরই সুবিধা
হবে।
ন্যাড়ার অনুমান একেবারে
সত্য বের হলো। পরেরদিনই জনি আর ননি গেলো বোমের বাড়িতে। বোমকে যেমন এটা ওটার লোভ দেখাতে
শুরু করলো। আমরা বোমকে যেমন শিখিয়েছিলাম, বোম তেমন অভিনয় করে রাজি হয়ে গেলো। ন্যাড়া
ইতোমধ্যে বোমের ঘরে নিজের মোবাইলের ক্যামেরা চালু করে রেখে দিয়েছে। সব রেকর্ড হয়ে গেলো।
Ôআব তেরা কেয়া হোগা ব্যাস মামু' মিশনের প্রথম অংশ সম্পন্ন। এইবার ২য় অংশ।
গোটা দায়িত্ব ন্যাড়ার ওপর। যেই ভিডিওটা করেছে, সেই ভিডিওটাকে এবার একটু পাল্টে ফেলতে
হবে। অর্থাৎ ভিডিওর এক জায়গায়, যেখানে জনি বোমকে বলছিলো Ôকেবল একদিনের জন্য তুই আমাদের দলে
অংশগ্রহণ কর' এই জায়গাটায় বসিয়ে দিতে হবে Ôসারাজীবনের জন্য তুই আমাদের দলে অংশগ্রহণ কর।' সেই কাজটা ন্যাড়া দক্ষতার
সাথে করে ফেলল।
এইবার ৩য়, অর্থাৎ শেষ
অংশ। এই অংশের দায়িত্ব আমার আর খেপুর ওপর। আমাদের কাজ হচ্ছে ব্যাসকে খানিকটা বেশি করে
উস্কে দেওয়া। তবে এখনই নয়। পার্টির দিন।
৫
দেখতে দেখতে চলে এলো সেদিন।
বোম সেজেগুজে তৈরি। জনি,
ননি আর বোম তিনজন মিলে চলে গেলো পার্টিতে। আমরা দৌড় লাগালাম টিম বিষের বাসায়। পৌঁছে
দেখি ব্যাস খাটে শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে মোবাইলে গেম খেলছে। শোনা যাচ্ছে বন্দুকের গুলির
আওয়াজ। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। অভিনয় শুরু।
Ôএই, তোরা এখানে কেন রে? কী মতলব তোদের?'
Ôবেশি কিছু না ভাই। তোকে একটু সমবেদনা জানাতে এলাম। বহত দুখ হোরাহাহেই তেরে
লিয়ে।'
Ôআমাকে নিয়ে দুঃখ। এই, কী বলবি ভালো করে বলতো।'
Ôতুমি এই স্থানে বসিয়া বসিয়া পাবজি খেলো, আর ঐ দিকে তোমার রিপ্লেসমেন্ট
যাইয়া কবজি ডুবাইয়া বিরিয়ানি, কেক গিলিয়া আসুক।'
Ôপাবজি, কবজি!! ওয়াহ খেপু। এই দুঃখের সময় তুই মাজাক কাররাহাহে?'
Ôব্যাস, থাম। তোদের কথার আগামাথা কিছুই বুঝছি না।'
আমি আর কিছু না বলে ন্যাড়ার
রেকর্ড করা ভিডিওটা ওকে দেখালাম। ব্যাস খুব মনোযোগ দিয়ে ভিডিওটা দেখলো। পুরো ভিডিও
দেখা শেষ। ব্যাস রাগে জ্বলছে। বোম থাকলে বলতো, Ôভিডিও দেখা শ্যাষ, রাইগ্যা গেছে ব্যাষ।' বুনো ষাড়ের চেয়ে এক তিল কম না।
প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, Ôওদের এত বড় আস্পর্ধা। মেরে সাথ বেঈমানি। মেই উনকো নাহি ছোড়ুঙ্গা। কাটডালুঙ্গা!!!'
আমাদের প্রায় ধাক্কা মেরে
ব্যাস বের হয়ে গেলো। আমরাও পিছে পিছে ছুটলাম। যাওয়ার সময় খেপু আমাকে বলছিলো, Ôক্রোধে লিপ্ত হইলে মনুষ্য নিজ মাতৃভাষা
ব্যবহার করে, এইটা কোথায় যেন শুনিয়াছিলাম। সেই সূত্র ধরিয়া দেখিতেছি, ব্যাস তো তোমারই
ভ্রাতা, নসুদা।'
আমি উত্তর করলাম, Ôভাই হোক, আর যাই হোক। পার্থক্য একটাই-
আমি হিন্দি মাঝে মাঝে বলি, আর ও গুসসে মে আ’কে বলে। সামাঝগ্যায়ে?'
ব্যাস ছুটেছে মোষের গতিতে।
আর আমরা ছুটছি ঢিলে তালে। পৌঁছে গেলাম সেখানে। পেঁপে ভাইয়া আর ন্যাড়া আগে থেকেই ওখানে
আছে। আমরা অনেকখানি মিস করেছি। আমরা পৌঁছে দেখলাম জনি-ননির সাথে ব্যাসের ঝগড়া হচ্ছে।
তবে সুখের কথা হচ্ছে, জনাব কুতশীত এখনো এখানে নেই। যাক, সেই রঙিন মুহুর্ত দেখার সুযোগ
হলো তাহলে।
Ôএরকম করিস না ভাই। তোর ভালোর জন্যই করেছি সব।'
Ôকিসের ভালো বে? তাড়িয়ে দিয়ে আবার ভালো কীভাবে করলি তোরা? '
Ôকেবল একদিনেরই তো ব্যাপার।'
Ôএকদিন? একদিন? কেবল একদিন? সারা জনমের জন্য নিয়োগ দিয়ে এখন বলছিস একদিন?'
Ôএই ভোম্বল। আয় এদিকে। বল, একে সত্যিটা বল। আমরা যে তোকে একদিনের জন্য ভাড়া
করেছি, সেইটা এই গাধাকে বোঝা।'
বোম এগিয়ে গেলো। মুখের
ভাব এমন যেন আকাশ থেকে পড়ছে। বলে উঠলো, Ôএকদিন জন্নে? কী সব কচ্ছাও? খালি একদিন। না না, তোমরা তো কইলে এখন থাইকা
আমি তোমারে দলেরই একজন। ঐ জন্নেই তো আমি আইলাম। আগে যদি জানতাম যে খালি একদিনের জন্নে,
তাইলে তো জীবনেও আসল্যাম নানি।'
জনতা আগ্রহ সহকারে এদের
ঝামেলা দেখছে। যাকে বলে দেখে চোখ জুড়িয়ে নেওয়া। এরা আশা করে আছে, কুতশীত সাহেব আসবেন,
আর ঝামেলা করার কারণে তাদের এখান থেকে বের করে দেবেন। আমরাও কুতশীত সাহেবের আসার অপেক্ষা
করে আছি। কিন্তু আমাদের আগ্রহ আরো বেশি। কারণ আমরা জানি, কুতশীত সাহেব এদের বের করে
দেবেন, কিন্তু এখানে ঝামেলা করার কারণে নয়। অন্য এক কারণে। মারাত্মক কারণে।
চলে এলো সেই সোনালী মুহুর্ত!!
ভিড় ঠেলে ঝামেলার ভেতরে ঢুকে পড়লেন ইনস্পেক্টর কুতশীত। আর সেখানে পৌঁছেই চোখাচোখি হলো
ব্যাসের সাথে। আর তারপর???
Ôইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহির রাজিউন??'
না, না। অতো বড় কিছু হয়ে
যায় নি। বড়জোর দোয়া ইউনুস পাঠ হয়েছে অনেকবার। কিন্তু অতো বড় কিছুই হয়তো হতো। কিন্তু
ব্যাস হতে দিলো না। কুতশীত সাহেবকে দেখেই তাঁর পা জড়িয়ে ধরে ফেলেছে সে।
কুতশীত সাহেব আদেশ করলেন,
Ôওঠ!
ওঠ বলছি!'
Ôনা না, আমি উঠবো না। আমি জানি, ওপরে উঠলেই আপনি আমাকে একেবারে ওপরে পাঠিয়ে
দেবেন।'
Ôকে বলেছে, না উঠলে পাঠাবো না?'
ব্যাস আর কোনো কথা না
বলে সোজা হয়ে উঠে দাড়ালো। তারপর আবার বলতে লাগলো, Ôআমাকে পেটানোর আগে কাহিনীটা শুনুন।' এই বলে এক নিঃশ্বাসে পুরো কাহিনীটা
বলল।
সব শুনে কুতশীত মশাইয়ের
মুখ লাল হয়ে গেছে। আগে যে রাগ কেবল ব্যাসের ওপরে ছিলো, এবার সেই রাগ তিন গুণ হয়ে পড়লো
গোটা টিম বিষের ওপর। এই মুহুর্তে যদি কাঁচা মাংস সমেত প্রেসার কুকারটা কুতশীত সাহেবের
মাথায় চাপানো হতো, তাহলে নিমিষে সব মাংস সিদ্ধ হয়ে যেতো।
আমাদের এলাকার লোকজনও
দেখি মহা চালাক। সুযোগ পেয়ে গেছে। ছাড়ে কে? আগুনে ঘি ঢালা শুরু করলো। জুবায়ের সাহেবের
কেচি কেড়ে নেওয়া, নবীনের বাবার শার্টে কাদা দেওয়া, চাপা ভাইয়ের চায়ে বালু দেওয়া, মুন্সীকে
থানায় ধরে নিয়ে আচ্ছা করে পেটানো ইত্যাদি সব খবর বের হয়ে আসতে লাগলো। শেষে আমাদের আহমদ
ভাইও ছাড় দিলো না। একুশবার ফ্রি নাস্তার বিষয়টিও ফাঁস হয়ে গেলো।
এই কথাগুলো শুনে কুতশীত
সাহেবের রাগ আরো কয়েক ডিগ্রী বেড়ে গেলো। চিৎকার দিয়ে উঠলেন, Ôআজ আমার হাত থেকে তোদের কেউ বাঁচাতে
পারবে না।'
টিম বিষ আর ওখানে নাই।
ছুটেছে। আর পেছনে কুতশীত সাহেব তাঁর বিখ্যাত লাঠি নিয়ে ওদের তাড়াচ্ছেন। আচ্ছা আচ্ছা
চাটি পড়ছে প্রত্যেকটার পেছনে। ব্যাসকে দেখলাম, পেছনদিকটা হাত দিয়ে ঢেকে দৌড়াচ্ছে। আর
উহ-আহ তো আছেই।
আমরা সবাই পিছনে দাঁড়িয়ে
ওদের কীর্তি দেখছি, আর হাসছি। বাকি লোকজন আমাদের পেছনে। তারাও বেশ খুশি। আজ তাদের জ্বালা
মিটলো। আমরা চ্যাঁচ্যাঁতে লাগলাম,
Ôআমাদের মুলুকে আমাদের দাদাগিরি চলবে, তোদের নয়।
তোরা টিম বিষ
এবার পুলিশের মার খেয়ে বলবি,
ইশ ইশ ইশ!!!'
কাহিনী শেষ

