প্রথমবারের যাত্রা

0


বিপ-বিপ


আওয়াজ শুনেই নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন দুই বিজ্ঞানী। তাদের সাড়ে ১৭ মাসের পরিশ্রম সফল হলো আজ।


প্রথম বিজ্ঞানীর নাম ড. মোহাম্মদ রাশেদ শাহেদ। এখানে কোনটা যে নাম, আর কোনটা যে পদবী বা সারনেম, তা বলা বেশ মুশকিল। ছেলেবেলায় কে যেন রেখে দিয়েছিলো এই নাম। তা আর জানা হয়নি তাঁর। অনেক খুঁজেছেন লোকটাকে, কিন্তু খোঁজ পাননি। কয়েকবার চেষ্টাতে পাননি যখন, তখন আর পাওয়ার চেষ্টাও করেননি। কী যায় আসে? তেমন কোনো আহামরি ব্যাপার তো নয়। শুধু একটা নাম, অদ্ভুত নাম! আর অদ্ভুত হবে না-ই বা কেন? মানুষটাই যে অদ্ভুত! চেহারার দিক দিয়ে অদ্ভুত কিছু নেই, বেশ সুদর্শন, কিন্তু মাথা সবসময় তাঁর অন্যরকমভাবে চিন্তা করে। সেদিক দিয়ে অন্যসব সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা তিনি। বিজ্ঞানীরা এমনিতেই অদ্ভুত ভাবেন, কিন্তু তিনি আবার একটু বেশিই অদ্ভুতভাবে ভাবেন। সত্যি কথা বলতে কী, বাংলাদেশের যতসব উদ্ভট এবং অদ্ভুত চিন্তাশক্তির অধিকারী বিজ্ঞানীদের তালিকা যদি করা হয়, তাহলে এই বিজ্ঞানী সাহেবের নাম যে প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে থাকবেই থাকবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 


আমরা এঁকে রাশেদ সাহেব হিসেবেই চিনবো।


দ্বিতীয় বিজ্ঞানীর নাম নাদিরা পারভিন। ইনি প্রথমজন, অর্থাৎ রাশেদ সাহেবের প্রথম ও একমাত্র সুযোগ্য সহধর্মিনী। তিনি রাশেদ সাহেবের মতো অদ্ভুত চিন্তার জগতে বিচরণ করেন না, বাস্তবজ্ঞানের ডানাতে ভর করেই ওড়েন সবসময়। কিন্তু তারপরেও তাঁকে রাশেদ সাহেবের শুধু স্ত্রী না বলে সুযোগ্য স্ত্রী বলা হয়েছে। এর কারণ হলো, আজ পর্যন্ত কোনো কাজেই তিনি রাশেদ সাহেবকে বাধা দেন নি। উলটো, প্রয়োজন হলে তাঁকে সাহায্য করেছেন। ঠিক যেমন এই প্রজেক্টটিতে। কিন্তু এইবার আসল প্রশ্নে আসা যাক। এঁরা দুইজন সাড়ে ১৭ মাস ধরে পরিশ্রম ও গবেষণা করে কী উদ্ভাবন করলেন?


 “একটি প্রাইভেট কার!” তার সামনের অংশে তিনটা সিট, আর পেছনের দিকে রয়েছে যন্ত্র-যন্ত্রাংশের মেলা। এগুলোর ভেতরে কোন যন্ত্র কী কাজ করে তা বিজ্ঞানীদ্বয় ছাড়া অন্য সব মানুষের কাছে অজানা। আর এখন তার বর্ণনা দেওয়ারও কোনো দরকার নেই। মেশিনটি ঠিকঠাক কাজ করলেই হলো।


কিন্তু তাঁরা সাড়ে ১৭ মাস ধরে একটা প্রাইভেট কার বানালেন মাত্র! কথাটা হাস্যকর হয়ে যেত যদি সেটা কোনো সাধারণ গাড়ি হতো। কিন্তু মোটেও তা নয়। আগেই বলা হয়েছে, রাশেদ সাহেবের ভাবনা সর্বদা অদ্ভুত! তাই তাঁর আবিষ্কারও যে অদ্ভুত কিছু হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই সহজেই বোঝা যায়, এটা কোনো সাধারণ গাড়ি নয়। অদ্ভুত ধরণের অন্যরকম। সাধারণ গাড়ি তৈরি হয়েছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য। বিজ্ঞানের ভাষায় স্থান পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু এই গাড়ি তৈরি হয়েছে স্থান পরিবর্তনের জন্য অবশ্যই, কিন্তু তার সাথে সাথে সময় পরিবর্তনের জন্যও।


হ্যাঁ, ঠিকই আন্দাজ করেছেন। এটা টাইম মেশিন। রাশেদ সাহেবের অনুমতি থাকলে এটার নামও টাইম মেশিনই হতো। কিন্তু তিনি আবার স্বকীয়তা বেশি পছন্দ করেন। কত সায়েন্স ফিকশন, কত মুভি, কত বই, কত উপন্যাস, সব জায়গায় কেবল একই শব্দ, টাইম মেশিন। তিনি চান না, তাঁর মেশিনও একই নামে পরিচিত হোক। তাই তিনি এ মেশিনের নাম দিলেন, “টাইমস্পেস কন্ট্রোলার কার।”


অনেকদিন ধরেই স্পেস এন্ড টাইম বিষয়ক ক্রিয়াকলাপ নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছিলেন রাশেদ সাহেব। গবেষণা করতে গিয়ে অনেক মহান বিজ্ঞানীর অনেক তত্ত্বের সাহায্য নিয়েছেন তিনি। ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবগুলো তলিয়ে দেখেছেন। তারপর অনেক গবেষণা শেষে তিনি নিজের তত্ত্বটি সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেন।


এই তত্ত্বের মাধ্যমে রাশেদ সাহেব দেখাতে পেরেছেন কীভাবে আমরা সময় ভ্রমণ করতে পারবো। অতীতেও যেতে পারবো, আবার ভবিষ্যতেও যেতে পারবো। কিন্তু আমরা অতীতের অথবা ভবিষ্যতের কোনো ঘটনা পরিবর্তন করতে পারবো না। সুতরাং, মাল্টিভার্সের দরজা বন্ধ। আমাদের টাইমলাইন একটাই, ভার্সনও একটাই। এই টাইমলাইনে আগে-পিছে যেতে পারবো, কিন্তু সেখানে আমরা শুধুই দর্শক। 


তাহলে কী হলো? অতীতে বা ভবিষ্যতে গিয়ে যদি কোনোকিছু পরিবর্তন করতেই না পারি, তাহলে আর মজা কী? কিন্তু কী আর করা যাবে। অতীত পরিবর্তন, ভবিষ্যৎ পরিবর্তন, মাল্টিভার্স এই সবগুলো রাশেদ সাহেবের আগ্রহের বিষয়। অতীতের ঘটনা পরিবর্তন যেন করা যায়, মাল্টিভার্সের অস্তিত্ব যেন থাকে, তা তিনি খুব করে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর তত্ত্ব তাঁকে সে সান্তনা দিলো না। তত্ত্ব থেকে যেসকল সমীকরণ বের হয়ে এসেছে, তাতে পরিবর্তন, মাল্টিভার্স সব সম্ভাবনা খাটিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু এতে সমীকরণ মেলানো গেলো না। সমীকরণ মিলে গেলো কেবল তখন, যখন ধরে নেওয়া হলো, অতীত-ভবিষ্যৎ পরিবর্তন অসম্ভব, মাল্টিভার্সের অস্তিত্ব নেই।


এই তত্ত্ব নিয়ে রাশেদ সাহেব যখন প্রথমবার বিবির সামনে মুখ খুললেন, তখন তাঁর বিবিসাহেবা তো কথাটাকে হেসেই উড়িয়ে দেন। তাঁর ক্লান্তিহীন হাসিও যখন রাশেদ রাহেবকে তাঁর জায়গা থেকে নড়াতে পারলো না, তখন তিনি সোজাসুজি বলে দেন, সময় ভ্রমণ অসম্ভব। রাশেদ সাহেব তখন অসম্ভব হওয়ার পেছনকার যুক্তি চান। উত্তরে বিবিসাহেবা প্রথমে হালকা হালকা কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেন, যেগুলো রাশেদ সাহেব আরামসে খণ্ডন করে দেন। 


পরিশেষে না পেরে বিবিসাহেবা সেই বিখ্যাত ‘গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স’ সামনে আনেন। অর্থাৎ, রাশেদ সাহেব অতীতে ফিরে গেলেন। সেই সময়ে চলে গেলেন যখন তার দাদুভাই কিশোর ছিলেন। তিনি গিয়ে তাঁর দাদুভাইকে মেরে ফেললেন। তাহলে মোট কী হলো? এটাই হলো যে, তাঁর দাদুভাই বিয়ে না করেই মারা গেলেন, ফলে রাশেদ সাহেবের বাবার জন্ম হলো না। আর রাশেদ সাহেবের বাবার জন্ম না হলে, রাশেদ সাহেবেরও জন্ম হবে না। আর রাশেদ সাহেবের জন্ম যদি না হয়, তাহলে টাইম মেশিন বানালো কে? অতীত ভ্রমণ করলো কে? দাদুকে মেরে ফেলল কে? এই সকল প্রশ্নের উত্তর অসংজ্ঞায়িত থেকে গেলো।


এত কড়া ডোজের প্যারাডক্সও রাশেদ সাহেবকে দমাতে পারলো না। উত্তর তৈরি ছিলো। তাই তিনি সটান বলে দিলেন যে গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স তখন কার্যকর হবে, যখন তিনি অতীতে গিয়ে তাঁর দাদুকে মেরে ফেলতে সক্ষম হবেন, অর্থাৎ কোনো ঘটনা পরিবর্তন করতে পারবেন। কিন্তু অতীত পরিবর্তন অসম্ভব। তাঁর সমীকরণ ইতোমধ্যেই সেটি দেখিয়ে দিয়েছে।


আর কিছু বলতে পারলেন না বিবিসাহেবা। এই যুক্তির কাছে হেরে গেলেন। অন্য কোনো থিউরি তাঁর মাথায় এলো না। নিজেও একটু আগ্রহ অনুভব করলেন এই প্রজেক্টটি নিয়ে। তবে সেটি স্বামীর সামনে প্রকাশ করলেন না। কিন্তু রাশেদ সাহেবও তৈরি লোক। বিতর্ক শুরু করার আগেই শর্ত রেখেছিলেন, বিতর্কে তাঁকে হারাতে না পারলে এই প্রজেক্টে তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করবেন নাদিরা পারভিন। ব্যাস, তাই ঠিক হলো।


এই হলো সাড়ে ১৭ মাসের আগের কাহিনী। অবশেষে তাঁরা যন্ত্রটাকে বানিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। দুই বিজ্ঞানীর বিশ্বাস, যন্ত্রটি ঠিকঠাক কাজ করবে। একজন পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস করেন, অন্যজন আংশিক।


এবার কাহিনী শুরু হোক।


ডাইনিং টেবিলে বসে আজ দীর্ঘ সময় পরে আয়েশ করে খাচ্ছেন রাশেদ সাহেব। এই কয়েক মাস সেভাবে খাবার খাওয়ার মজা নিতে পারেন নি। এইবার সে সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর সাথে যোগ দিয়েছেন তাঁর বিবিসাহেবা, আর তার তিন সন্তান। রাফিয়া, শাফিয়া, আর নাদিম।


রাফিয়া আর শাফিয়া দুইজন জময। দুইজনের বয়স এগারো। নাদিম আরো ছোট। তার বয়স সাত। এই তিনজন যেখানে আছে, সেখানে আর নিস্তব্ধতা বলে কিছু থাকে না। নাদিম হলো সবচেয়ে ছোট, কিন্তু দরকার হলে দলের নেতৃত্ব দিতে এক পায়ে খাঁড়া। দুই বোন সানন্দে নেতৃত্ব মেনে নেয়। আবার মাঝে মাঝে কিলাকিলি, চুলোচুলি, ঘুষোঘুষি এগুলো তো লেগেই আছে। তবে যতই খুনসুটি করুন না কেন, সবাই জানে, ওরা পরস্পরকে কতটা ভালোবাসে। এখানেই বলে রাখি, এরাই হবে আমাদের আগামী গল্পগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্র!


আজ রাতেই মেশিনে চেপে বেড়িয়ে পরার আশায় প্রস্তাব রেখেছিলেন রাশেদ সাহেব। কিন্তু তাঁর বিবিসাহেবা তাতে সায় দিলেন না। তাঁর ইচ্ছা, আপাতত কিছুদিন তাঁরা পরিবারসহ নিরিবিলি সময় কাটাবেন।


কিন্তু নিজের আবিষ্কার চালিয়ে দেখার অদম্য আকর্ষণ রাশেদ সাহেবকে স্বাভাবিক থাকতে দিচ্ছিলো না। তাই এক সপ্তাহের বেশি তিনি আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। এক সপ্তাহের মাথাতেই পুরো পরিবার নিয়ে হাজির হলেন নিজেদের ল্যাবরেটরিতে, টাইমস্পেস কন্ট্রোলার কার এর সামনে। মেশিনের কার্যক্রমের ফিল্ড টেস্ট নেওয়ার জন্য।


রাশেদ সাহেব ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন যন্ত্রটির কাছে। পর্দা উঠিয়ে ফেললেন। বলা বাহুল্য, এই পর্দাটিও অসাধারণ এবং অদ্ভুত কায়দায় রাশেদ সাহেব কর্তৃক তৈরি। তাইতো মেশিনের ওপর এক চিমটি ধুলো পর্যন্ত পড়েনি। মাকড়শা তো দূরে থাক, বাতাসও এর সংস্পর্শে আসতে পারেনি বোধহয়। রাশেদ সাহেব গাড়ির দরজা খুলে সোজা ঢুকে পড়লেন। পুরো পরিবার তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাফিয়া শাফিয়ার মন খারাপ। নাদিরা সাহেবাও কিছু বলছেন না। তাঁর কেবল মনে হচ্ছে যেন তাঁর কোনো একটা প্রিয় জিনিস তাঁর কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। কেবল নাদিম খানিকটা নির্বিকার। সে উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে কী হয় তা দেখার জন্য।


রাশেদ সাহেব বসে পড়লেন সিটে। নিজের ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস আছে তাঁর। তিনি যেন জেনে বসে আছেন যে কী হবে। হাসিমাখা মুখ নিয়ে বিবিসাহেবার দিকে তাকাতেই, সেই সময় বিবিসাহেবার চোখের একফোঁটা পানি তাঁর নজরে এলো।


রাশেদ সাহেব তাঁর বিবিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমার কি এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না? এইতো, সুইচ চাপবো, বেড়াতে চলে যাবো, আর পাঁচ মিনিটে চলে আসবো। বিশ্বাস করো, আমার কিছু হবে না।’


বিবিসাহেবার কাছ থেকে উত্তর এলো, ‘মাথা তো বিশ্বাস করেছে। কিন্তু মন বিশ্বাস করছে না।’


ইতোমধ্যে শাফিয়া মুখ খুলল, ‘আব্বু, তুমি যদি ফিরতে না পারো, তাহলে?’


রাশেদ সাহেব রসিকতায় মেয়েকে বোঝালেন, ‘আম্মু, তুমি এমনটা ভাবছ কেন বলোতো। তুমি আর রাফিয়া সবসময় পজিটিভ ভাববে। ন্যাগেটিভ ভাবা তো তোমার মা আর তোমার ভাইয়ার কাজ!’


নাদিম চটে উঠে বলল, ‘কেন? কেন? আমি আর আম্মু ন্যাগেটিভ ভাববো কেন?’


রাশেদ সাহেবের সটান উত্তর, ‘কেননা, তোমার আর তোমার মায়ের, দুইজনার নামই “ন” দিয়ে শুরু।’


রাফিয়া পিতার এই কথা শুনে কষ্টে রেগে উঠলো। বলল, ‘এই সময়ও তুমি ইয়ার্কি মারছো আব্বু? ভালো লাগছে না কিন্তু!’


রাশেদ সাহেব হয়তো সান্তনা দেওয়ার মতো করেই বললেন, ‘কেন ভালো লাগবে না? ভালো লাগতে হবে। এই দেখো, আমি এই যাবো আর এই চলে আসবো।’


আর কথা বাড়ানোর সুযোগ দিলেন না রাশেদ সাহেব। বিবিসাহেবা হয়তো শেষবারের মতো কিছু বলতে চেয়েছিলেন। সন্তানেরা হয়তো আরো একবার পিতার কোলে আশ্রয় নিতে চেয়েছিলো। চেয়েছিলো হয়তো গলা জড়িয়ে ধরে একবার শুভবিদায় জানাতে। কিন্তু তা আর সম্ভব হতে দিলেন না রাশেদ সাহেব। গাড়ি স্টার্ট দিলেন। সবাই দেখতে লাগলো ধীরে ধীরে আবছা হচ্ছে গাড়িটি। এবং একসময় হঠাৎ করে গাড়ি অদৃশ্য হয়ে গেলো। তিন সন্তানকে কাছে টেনে নিয়ে স্বামীর অদৃশ্য হওয়ার জায়গাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন নাদিরা পারভিন। এক অজানা বিয়োগব্যথা তাঁর প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে দিচ্ছিলো।


এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট। চলছে সময়। নিজ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নাদিরা সাহেবার মনে হচ্ছিলো প্রতিটা সেকেন্ড যেন এক একটা বছরের সমান। এভাবেই কেটে গেলো টানা এক ঘণ্টা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই ঘণ্টা ঐ একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো গোটা পরিবার। দৃষ্টি কেবল একই জায়গায় নিপতিত। রাফিয়া-শাফিয়া চোখের পানি ফেলছে। পুরোপুরি নিঃশব্দে। নাদিরা সাহেবার কোনো নড়াচড়া নেই। যেন জমে পাথর হয়ে গেছেন। কেবল নাদিম অনেকটা স্বাভাবিক রয়েছে।


একজায়গায় যদি টানা একভাবে তাকিয়ে থাকা যায়, তাও আবার হারানোর ব্যাথা নিয়ে, তাহলে কিছু না দেখাই স্বাভাবিক। নাদিরা পারভিন, রাফিয়া আর শাফিয়ারও তা-ই হয়েছিলো। কেবল নাদিমের চোখের পাতা প্রতি ২ সেকেন্ডে একবার করে পড়ছিলো।


তাই হয়তো পিতার অদৃশ্য হওয়ার জায়গায় কিছু একটা ঝাপসা সে দেখতে পেলো। পেয়েই চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘ঐতো, আব্বু ফিরেছে।’


রাফিয়া-শাফিয়া তৎক্ষণাৎ সজাগ। চোখ ডলতে লাগলো দুজনেই। নাদিরা পারভিন তখনো নির্বিকার। কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না।


রাশেদ সাহেবের মেশিন তাঁকে নিয়ে ফিরে এসেছে। বীরবেশে তিনি গাড়ি থেকে নামলেন। শুধু বীরবেশে নয়, বীরবেশে এবং বরবেশে। গিয়েছিলেন সাধারণ শার্ট-প্যান্ট পরে। আর এসেছেন পাঞ্জাবি-পায়জামা-পাগড়ি এগুলো পরে। কিন্তু কেন?


সকলে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। প্রায় দশটা মিনিট কেটে গেলো নিশ্চুপভাবে।


নীরবতা ছাপিয়ে নাদিরা সাহেবা বলে উঠলেন, ‘আর না। আর কখনোই না। তোমাকে আমি ঐ মেশিন স্পর্শ করতেও দেবো না। তুমি এখানে থাকবে। আমাদের সাথে থাকবে। আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবে না। খুব বড় বিজ্ঞানী হয়ে গেছো তাই না? কেন? কীসের জন্য এমন আবিষ্কার করতে হয় যার ফিল্ড টেস্ট নিতে গিয়ে প্রাণের সংশয় থেকে যায়? সহজ কিছু তোমার মাথায় আসে না……’


আরো দুই মিনিট একটানা বলে গেলেন রাশেদ সাহেবের বিবিসাহেবা। থামলেন না। দাড়ি, কমা, সেমিকোলনসহ কিছুই তাঁর জিহ্বাকে থামাতে পারলো না। দম নিচ্ছেন কিনা সন্দেহ! রাশেদ সাহেব বাধা দিতে গিয়েও দিতে পারলেন না। কেননা তিনি বুঝতে পারলেন, এত কথার মাধ্যমে বিবিসাহেবা তাঁর মনে ভেতরে চেপে রাখা চাপটা বের করে দিতে পারছেন। এক পর্যায়ে যখন তাঁর কণ্ঠ ধীর হয়ে গেলো, রাগের পরে যে তীব্র কান্নার অনুভুতি বিবিসাহেবাকে ঘিরে ধরলো, সেই মুহুর্তে রাশেদ সাহেব তাঁকে বুকে চেপে ধরলেন। বিবি তাঁর বুকে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন।


দীর্ঘ বক্তব্যের পর হাফ ছাড়লেন নাদিরা সাহেবা। ভেতর থেকে শান্তি অনুভব করছেন তিনি।


ইতোমধ্যেই রাশেদ সাহেব ঠাট্টা করে বললেন, ‘যাক, ভুমিকম্প থামলো!’


নাদিরা সাহেবা স্বামীর দিকে কটমট করে তাকালেন। তাঁর যেন বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে তাঁর এত গম্ভীর কথাগুলো তাঁর স্বামী গায়েই লাগান নি। প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে দিলেন, ‘তোমার সবকিছুতেই ইয়ার্কি তাই না? যদি তোমার কিছু হয়ে যেত?’


‘তাহলে তুমি নিজেই ছেলেপুলেদের মানুষ করে ফেলতে। সহজ হিসাব!'


নাদিরা সাহেবা এবার স্বামীর বুকে কিলানো শুরু করলেন। রাশেদ সাহেব বারণ করলেন না, হাসতে হাসতে বললেন, ‘দেখেছিস আব্বু-আম্মুরা, তোদের আম্মু একটু আগে আমার প্রাণ নিয়ে কত কথা শোনালো, আর এখন নিজেই কিলিয়ে কিলিয়ে আমার হার্টফেল করিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করছে।’


নাদিরা সাহেবা আবার কেঁদে ফেলেন। তাঁর কান্নায় রাশেদ সাহেবের জামা ভিজে যেতে থাকে। রাশেদ সাহেব বিবির চোখ মুছিয়ে দিয়ে গাল টিপে বলেন, ‘আরে ধুর, মজা করছিলাম। কিলিয়ে কিলিয়ে আমার হার্টফেল করাবে তুমি? সে গায়ের জোর তোমার আছে?’ তারপর সবাইকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘আর এমনিতেই, তোমাদের প্রত্যেকের দোয়া আমার সাথে আছে। আল্লাহ তায়ালা আমাকে সব ক্ষতি থেকে রক্ষা করবেন, দেখে নিও।’


সবার কান্নার গতি বেড়ে যায়। ওদের অবস্থা দেখে রাশেদ সাহেবের নিজের চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ে। তিনি আর সামলাতে না পেরে বলেন, ‘এবার ছেড়ে দাও। তোমাদের চোখের জলে আমার গোসল তো এখানেই হয়ে যাচ্ছে।’


এটুকুতেই শেষ। তারপর সারাদিনের জন্য বিশ্রাম নিতে হলো রাশেদ সাহেবকে। একরকম বাধ্য হয়েই। পরিবারের সদস্যগুলো এমন চাপ দিয়েছে যে রাশেদ সাহেব একেবারে চুপসে গেছেন বেলুনের মতো। কারো একবারের জন্যেই মনে পড়ছে না রাশেদ সাহেবের পোশাকের ব্যাপারটা। কীভাবে তাঁর যাত্রাপথে পোশাক বদলে গেলো। কোন উপায়ে তিনি সাধারণ পোশাকে মেশিনে চড়লেন, আর ফিরে আসলেন বরের বেশে? এই সকল প্রশ্ন কারো মনেই আসলো না। হয়তো এসেছিলো। বিজ্ঞানী মহাশয়কে প্রশ্ন করার ইচ্ছাও হয়েছিলো। কিন্তু দিনশেষে, কিছুই ঘটলো না।


ঘটলো না বললেও ভুল হবে। ঘটেছে। ঘটেছে রাশেদ সাহেবের সাথে। ছোটবেলা থেকেই পেটে কথা চেপে রাখার কোনো চেষ্টা করতেন না তিনি। যার ফলে এই বয়সে এসেও পেটে চেপে রাখা তো দূরে থাক, বলতে না পারলে তাঁর পেট ফেঁপে ওঠে। বমি, হিচকি সব একসাথে আসে। এবারেও তার ব্যাতিক্রম ঘটলো না। অতি সাবধানে রাতের খাবার শেষ করলেন তিনি সবার সাথে। আর তারপরেই শুরু করলেন তাঁর পেট হালকা করার কার্যক্রম।


‘নাহ, আর সহ্য করা যায় না। এবার বলতেই হবে। বলব। আমি বলেই ছাড়বো। তোমরা না শুনলেও একা একা বিড়বিড় করবো। তবুও বলবই।’


নাদিম জবাব দিলো, ‘আব্বু, তোমার গল্প যদি আমরা নিজেদের কানে ঢুকতে না দিই, তাহলে কী হবে জানো? সেগুলো দেয়ালে আঘাত করে প্রতিফলিত হয়ে আবার তোমার কানেই ফিরে আসবে। তাতে পেট আবার ফুলে যাবে। তাহলে একা একা বলে কোনো লাভ নেই, তাই না?’


‘ভাইয়া, সত্যি করে বল তো, তুই প্রতিফলনের বিষয়টা নির্ঘাত ক্লাস নাইনের বই পড়ে শিখেছিস। তাই কিনা?’ রাফিয়া জিজ্ঞেস করলো।


‘কেন আপু? তুই উচ্চ মাধ্যমিকের বই পড়লে কিছু না, আর আমি মাধ্যমিক ধরলেই দোষ?’ নাদিমের সটান উত্তর।


রাশেদ সাহেবের অবস্থা খারাপ। পেরেশানি যুক্ত মুখ নিয়ে বললেন, ‘যদি কুলাতে পারো, তাহলে যার যে ক্লাসের খুশি বই পড়বে। কিন্তু সেটা কথা না। কথা হচ্ছে এইটা যে, আমাকে আমার গল্প শুরু করতে হবে।’


‘ঐ, ঐ’, নাদিরা সাহেবার আওয়াজ শোনা গেলো, ‘তুমি একদম আমাদেরকে ঐসব বলতে আসবে না। আমরা কেউ আর ঐ মেশিন নিয়ে আগ্রহী নই। সুতরাং, চুপ থাকো।’


‘এ আপু, তোর আম্মুকে একটু চুপ করতে বলবি কি? তোর আম্মু এত ভীতু কেন?’ এটা নাদিমের আওয়াজ।


‘শুধু আমাদের আম্মু, তোর কেউ না? তোরও তো আম্মু। একটু বোঝা না ভাই। আমার গল্প শুনতে ইচ্ছা করছে।’ শাফিয়া জবাব দেয়।


তারপরে রাফিয়া বলল, ‘শোন নাদিম, আম্মুকে তুই বোঝা। আমাদেরকে বলিস না। আমরা এখন গল্প শুনবো।’


নাদিরা সাহেবা এগুলো শুনছেন আর তেলে-বেগুনে জ্বলছেন। শেষ পর্যন্ত যে রাগ আগে কেবল স্বামীর ওপর ছিলো, তা সকলের মাঝে সমবণ্টন হয়ে গেলো। চেচিয়ে উঠলেন, ‘ও, তাই না? তোরা মনে হচ্ছে একেকটা সাহসের সাগর হয়ে গেছিস? ঠিক আছে, প্রমাণ হয়ে যাক, কে বেশি ভীতু, আমি নাকি তোরা। ঐ, তিন বাচ্চার আব্বু, তুমি তোমার কাহিনী শুরু করতে পারো।’


সকলের ছাদে চলল। ছাদের প্রায় সবটুকুই গাছপালা দিয়ে ভর্তি। জায়গাটা এমন হয়েছে যে এটাকে একটা পিকনিক স্পট বললেও ভুল হবে না। ছাদের মাঝখানে একটা বিশাল ছাতা টাঙ্গানো। তার নিচে পাতা আছে আরামদায়ক সোফা। রাশেদ সাহেব গিয়ে প্রথমে ছাতা খুলে ফেললেন। কারণ ছাতার কাজ কেবল রোদ-বৃষ্টি আর কুয়াশা থেকে রক্ষা করা। এখন এর কোন কাজ নেই। এই মুহূর্তে ছাতাটি সমস্যা নিরোধক না হয়ে, বরং সমস্যা সৃষ্টিকারক হিসেবে কাজ করছে। আজকে পূর্ণিমার রাত। জ্যোৎস্নার আলোয় চারদিকে ঝলমল করছে। আর এই পূর্ণিমার দিনে চাঁদ না দেখলে হয়?


এই যে প্রতিদিন সকালে এখানে বসে চা আর খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সূর্যোদয় দেখা, বিকেলবেলা গাছের যত্ন নেওয়ার সাথে সাথে প্রকৃতির বাতাস গায়ে লাগানো, শীতকালে কাঠে আগুন ধরিয়ে ক্যাম্প ফায়ারের মজা নেওয়া, বর্ষাকালে বিশেষ কায়দায় নিজের চারপাশে ভীষণ মজবুত কাচের দেয়াল তুলে তার ভেতর থেকে বৃষ্টি দেখা, আর সর্বোপরি রাতের বেলা আকাশে তারা দেখতে দেখতে বা চাঁদের আলো গায়ে মাখতে মাখতে পরিবারের সাথে আড্ডা দেওয়া, এই কাজগুলোই হয়তো এই দুই বিজ্ঞানী কে এখনও রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাছাড়া তারা এত পরিমাণে যন্ত্রপাতির পেছনে পড়ে থাকেন যে, কবে যেন যান্ত্রিক হয়ে যেতেন। টের-ই পেতেন না।


সকলে আরাম করে বসলো। রাশেদ সাহেব বসলেন না। এটাই নিয়ম। যে গল্প শোনাবে, তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করে গল্প শোনাতে হবে। রাশেদ সাহেবের জন্য নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। তাই নিয়মকানুন মেনে তিনি গল্প শুরু করলেন।


'মেশিন স্থান এবং সময় পরিবর্তন করতে পারে। এবং মেশিন যেখানে থাকে, সেইখানকার অবস্থান আর সময় মেশিনে ডিফল্ট হিসবে সেট করা থাকে। আমাকে যেখানে যেতে হবে, কেবল সেই নির্দিষ্ট স্থানের দ্রাঘিমারেখা ও অক্ষরেখা ঠিক করে দিতে হবে, আর সময়টা বলে দিতে হবে। সময়টা আমি পরিবর্তন করেছিলাম। কিন্তু আমি এই জায়গাতেই উপস্থিত হতে চেয়েছিলাম বিধায় স্থানের কিছু পরিবর্তন করি নি। সেভাবেই সুইচ টিপে দিলাম।


সাথে সাথে আশেপাশের সবকিছু ঘোলা হতে শুরু করলো। তোরা মোবাইলের ক্যামেরায় পোট্রেট মোডে ছবি তুললে ব্যাকগ্রাউন্ডের যে অবস্থা হয়, ঠিক সেরকম। ধীরে ধীরে ঘোলাত্ব বেড়ে গেল। শেষ পর্যায়ে এমন অবস্থা হলো, মনে হলো আমি যেন নোংরা কাদাময় পানিতে ডুব দিয়ে বসে আছি। তারপর হঠাৎ আলোর এক ঝলক দেখলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই করে মেশিন সমেত ধা করে ঢুকে পড়লাম কিছু একটার ভেতর। ঠাহর করার সুযোগ না পেলেও আমি দ্বিধাহীন মনে বলতে পারি, ওটা ওয়ার্মহোল।


তার ভেতরে ঢুকেই দেখলাম সব আঁধার। কিছু দেখা যায় না। আমি মিনিট দুয়েকের মত চোখ বন্ধ করে থাকলাম। সময়টা আমাদের হিসেবে মিনিট দুই হতে পারে। কিন্তু কে জানে? হয়তো তার চেয়ে আরও লক্ষ কোটি গুণ হবে! যাইহোক, একপর্যায়ে আমি চোখ খুললাম। দেখতে পেলাম ধীরে ধীরে অন্ধকার কমে যাচ্ছে, আবার ঘোলা ঘোলা সবকিছু দেখা যাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ পর পরিষ্কার হতে শুরু করল। সবকিছু শেষে আমি দেখলাম, আমি ঠিক সেখানেই আছি যেখান থেকে রওনা দিয়েছিলাম।


কিন্তু তারিখ পরিবর্তন করেছিলাম। কোন তারিখ জানো? আজকের তারিখ-ই। কিন্তু উনিশ বছর আগেকার। তাই আমি উনিশ বছর পেছনের এই দিনে চলে গিয়েছিলাম। আর যেহেতু স্থান পরিবর্তন করে দিই নি, তাই যেখানে থেকে আমি রওনা দিলাম অর্থাৎ আমার ল্যাবরেটরী, আমি ঠিক সেখানে গিয়েই পৌছালাম। এখন তো এখানে আমার ল্যাবরেটরী। কিন্তু তখন সেখানে গাড়ি রাখাত গ্যারেজ ছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি গ্যারেজের একবারে মধ্যখানে উপস্থিত হলাম।


উনিশ বছরের লিপিইয়ার-টিপইয়ার মিলিয়ে হিসেব করলে চাঁদের হিসেব পেলেও পেতে পারি। কিন্তু হিসেব করে দেখি নি। দেখার ইচ্ছা ছিলো, কেননা সেদিনও আজকের মতো পূর্ণিমা দেখেছিলাম। চাঁদের আলো গ্যারেজের জানলা দিয়ে ঢুকে গ্যারেজঘর আলোকিত হয়ে গিয়েছিলো। এক মায়াভরা দারুন পরিবেশ। ধীর-স্থির-সাদাকালো। আমি প্রাণভরে অবলোকন করছিলাম অতীতের পরিবেশ। সবকিছু চিরচেনা। আমার অতীত। সোনালী অতীত। আহা!


হঠাৎ করে আমার সব আবেগের দফারফা করে দিয়ে ঘরের টিউবলাইটটা জ্বলে উঠলো।


খটখট শব্দ পেলাম। নির্ঘাত কেউ গ্যারেজের দরজা খুলছে। মানে শাটার খুলছে। ভেতরে ঢুকবে। আর ঠিক হলোও তাই। দরজা খুলে গেল। নাগরাই জুতার খটখট শব্দ নিয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত একজন আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। মুখ তখনো দেখা যাচ্ছিলো না।


ধীরে ধীরে সে আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো। আমি আস্তে আস্তে স্পষ্ট করে মুখটা দেখতে পেলাম। এক ঝলক দেখেই চিনতে পারলাম। সুঠাম দেহ, লাজুক ভাব, আর তার সাথে চিরচেনা একটা মুখ।'


গল্পের এপর্যায়ে এসে নাদিম মুখ না খুলে পারলো না। জিজ্ঞাসা করল, ‘কে ছিল ওইটা?’


রাশেদ সাহেব উত্তর দিলেন, ‘কে আবার হবে? লোকটা ছিল স্বয়ং আমি।’


এটা শুনে বাকি সবাই অতি আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলেও নাদিরা সাহেবা বলতে গেলে একটু খেপেই গেলেন। মনে মনে বলতে লাগলেন, ‘এমনভাবে প্রশংসা করল, যেন কত না গুণবান, স্বাস্থবান, হ্যান্ডসাম ছিল! হুহ! ঢং!’


রাশেদ সাহেব তার বিবিসাহেবাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু বললে নাকি?’


নাদিরা সাহেবা চমকে উঠেছেন। ভাবলেন, ‘আমি তো মনে মনে বিড়বিড় করছি। আর এই লোকটা তাও বুঝে গেলো নাকি?’ কিন্তু আমতা আমতা করে মুখে বললেন, ‘না, না। কী বলবো? কিছুই বলিনি। তুমি চালিয়ে যাও তোমার গল্প।’


রাশেদ সাহেব আবার শুরু করলেন, ‘আমার দিকে আমিই এগিয়ে আসছিলাম। উনিশ বছরের পুরনো আমি, উনিশ বছর পরের আমির দিকে এগিয়ে আসছিলাম। আমি শিহরিত। আমি রোমাঞ্চিত। তখনকার অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। যখন দেখছি আমার-ই ডুপ্লিকেট, আমারই উনিশ বছরের জুনিয়র ভার্সন আমার দিকে এগিয়ে আসছে, তখন ভেবে দেখ কেমন লাগে? তোমাদের কীভাবে বোঝাবো?’


নাদিরা সাহেবা আবার মনে মনে বলা শুরু করলেন, ‘এমন ভাব করছে যেন ওইরকম অনুভূতির জগতের কারও হয়নি! কেন? আয়নার দিকে এগিয়ে গেলেও তো নিজের ডুপ্লিকেট মহাশয় এগিয়ে আসেন, তখন তো ওরকম শিহরণ জাগে না! হুহ! ঢং দেখে আর বাঁচি না।’


রাশেদ সাহেব বিবিকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি আবার কিছু বললে নাকি?’


নাদিরা পারভিন রেগে উঠলেন। বারবার তাঁর স্বামী বাবাজী তাঁর মনে খবর পাচ্ছে কীভাবে? চেঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘আশ্চর্য! তুমি গল্প ছেড়ে বারবার আমার পেছনে পড়ছো কেন শুনি?’


‘না, কেন জানিনা মনে হচ্ছে তুমি একটু পর পর আমার গল্পে ফোড়ন কাটছো।’


‘কাটলে কাটছি। তাতে তোমার কী? তোমার গল্পে তো কোনো বাধা পড়ছে না। কেউ তো সেগুলো শুনতে পাচ্ছে না।


‘শুনতে না পেলেও, অনুভব তো করতে পারি, প্রিয়তমা!!’


‘প্রিয়তমা?’ নাদিরা সাহেবার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে, ‘ঐ, তোমার মগজের ঘিলুগুলো সব শুকিয়ে গেছে নাকি? ছেলেমেয়েদের সামনে এসব বলছো!’


রাফিয়া-শাফিয়া দুজন মিলে তখন এত জোরে চিৎকার দিলো যে সবাই চুপ হয়ে গেলো। কারো মুখে কথা নেই। চারদিকে যখন পিনপতন নীরবতা নেমে এলো, তখন রাশেদ সাহেব সুযোগ বুঝে আবার গল্প বলা শুরু করলেন।


'আমি আমার দিকে ক্রমেই এগিয়ে আসছিলো। আমি শুধু দেখে যাচ্ছি কী হয়। আমাকে দেখে সে কেমন আচরণ করে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। সে এমন ভাবে আমার পাশ দিয়ে চলে গেল, যেন আমি ওখানে উপস্থিত মেশিন সমেত, কিন্তু সে আমাকে দেখতে তো পায়ইনি, এমনকি টের অবধি পায়নি।


আমিও নাছোড়বান্দা। মেশিন থেকে বের হয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম বাইরের দরজার সামনে। তাঁকে তো দরজা দিয়েই বাইরে যেতে হবে। তখন আমাকে উপেক্ষা করবে কীভাবে?


আমার জুনিয়র ভার্সন আমার পুরনো গাড়ির কাছে গেছে। সম্ভবত সে গাড়ি বের করতেই ঢুকেছে গ্যারেজে। গাড়িতে চড়ে বসলো সে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে চালানো আরম্ভ করলো। দরজার দিকে অর্থাৎ আমার দিকে আসতে লাগলো। এই বুঝি আমার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়! কিন্তু আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি জানতাম, আমার কিচ্ছু হবে না। যদি আমার কিছু হয়, তাহলে তো টাইম মেশিন ভবিষ্যতে তৈরি হবে না। আর আমি অতীতে আসতেও পারবো না। কিন্তু যেহেতু আমি অতীতে আসতে পেরেছি এবং টাইম মেশিনে চেপেই এসেছি, তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার কিছু হবে না। সেই বিশ্বাসে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।


এবং আমার বিশ্বাসকে সত্য করে দিয়ে, জুনিয়র গাড়ি চালিয়ে চলে গেলো। আমাকে ভেদ করে!!


শুধু তাই নয়, গাড়ি বাইরে বের করে নেমে এসে সে গ্যারেজের শাটার বন্ধ করলো। শাটারটিও আমার মাথার ওপর থেকে নেমে আমাকে ভেদ করে মাটিতে গিয়ে ঠেকলো। আমি যেহেতু ঠিক ফ্রেমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তাই শাটার বন্ধ করার পর দেখা গেল, আমার শরীরের অর্ধেক গ্যারেজের ভিতর, আর বাকি অর্ধেক বাইরে।”


‘নিজেকে তখন কেমন মনে হচ্ছিল আব্বু?’ নাদিম জিজ্ঞাসা করে।


‘হলোগ্রাফিক ইমেজ! ঐ যে সেদিন তোমাদের এক আঙ্কেল হলোগ্রাফিক ইমেজের মাধ্যমে আমাদের সাথে কথা বললেন। তুমি আঙ্কেলকে ছুঁতে গিয়ে আঙ্কেলের পেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলে। মনে আছে তো?’


‘হ্যাঁ, মনে আছে তো।’


‘ঠিক ঐরকম অবস্থায় ছিলাম আমিও। কিন্তু অনুভূতিটা ছিল মারাত্মক বিচিত্র! যেন আমি না জানি কয় মাত্রার জীব হয়ে গেছি। গ্যারেজের দেয়াল, সামনের গাছ, সবকিছুর কোনটাই আমাকে আটকাতে পারছিলো না। আমি সব কিছুর ভেতর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমি একদম সবকিছু ভেদ করে যাচ্ছিলাম। গাছের ভেতরে ঢুকে পড়ে গাছের জাইলেম-ফ্লোয়েম টিস্যু, প্যারেনকাইমা, কোষপ্রাচীর সব হয়তো দেখতে পেতাম, কিন্তু কাছে অণুবীক্ষণ ছিলো না।


কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হলো, বাসা থেকে আরও দু’জন লোক বের হয়ে গাড়িতে চড়ে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গেট দিয়ে বের হতে লাগলো। আমি আর দেরি না করে দৌড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বুঝলাম, আমি উড়তে, না মানে বাতাসে ভেসে এগিয়ে যেতে পারছি।’


‘তুমি উড়তে পর্যন্ত পারছিলে?’ রাফিয়া জিজ্ঞেস করল।


‘জানো আম্মু, এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে, তার সাথে একটা অনেক বড় প্রশ্নের উত্তর। ঐসময় আমার বাসার উঠোনে প্রচুর ঘাস ছিল। কিন্তু আমি যখন ঘাসের উপরে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন ঘাস কিন্তু মোটেও নুইয়ে পড়েছিলো না। ঘাসের ওপরে আমার পা পড়ছে না, তবে কি ঘাস ভেদ করে মাটিতে পড়ছে? না, সেটাও না। পা ছিলো একেবারে শুন্যে। পরীক্ষা করতে মাটির ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। আবার পা উপরে তুলেও দেখেছিলাম, হাওয়ার ভর দিতে পারছিলাম আমি।’


‘এ আবার কেমন কথা?’ শাফিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘এর কোনো ব্যাখ্যা আছে তোমার কাছে?’


রাশেদ সাহেব বললেন, ‘দেখ আম্মু, উত্তরটা সহজ। ওই সময়ে আমার অস্তিত্ব কোনো স্বাভাবিক মানুষের মতো হওয়ার কথা না। আর তারপরেও, আমরা যখন মাটিতে পা ফেলি, তখন আমরা পা দিয়ে মাটির ওপর বল প্রয়োগ করি। তাতে মাটির অণু-পরমাণুগুলো একটু হলেও তলিয়ে যায়, যেটা শক্ত মাটিতে না হলেও, বেলে অথবা কাদামাটিতে সহজেই হয়। কিন্তু দেখ, ওখানে যদি তাই হতো, যদি মাটি সরে যেত বা ঘাস নুইয়ে পড়তো, তাহলে তো অতীত পরিবর্তিত হয়ে যেত। কারণ আসলে ঐ সময় ঘাসের তো নুইয়ে পড়ার কথা না। আবার যদি নুইয়ে পড়েও, মাটির পরমাণু সরে গেলেও, সেটা নিশ্চয়ই অন্য কারনে ঘটবে। কোনো মানুষের পায়ের চাপে তো অবশ্যই ওই মুহুর্তে এমন ঘটবে না।


সহজ কথায় অতীতে গিয়ে যদি আমি কাদার উপর হাঁটি, তাহলেও কাদার ওপর চাপ পড়ে আমার পায়ের ছাপ উঠবে না। অতীতে গিয়ে যদি আমি বালু মাটির উপর হাঁটি, তবুও বালু সরে যাবে না। আর বাতাস ভেদ করে যে হাঁটছিলাম, বাতাসও সরে যাচ্ছিল না।’


নাদিম আফসোসের সুরে বলে, ‘তার মানে আসলেই তুমি অতীতে কেবল একটা নীরব দর্শক ছিলে? অতীতে গিয়ে যদি কিছু করতেই না পারলাম, তাহলে আর কী?’


‘তাহলেও অনেক কিছু।’


‘কিন্তু তুমি তো অতীত পরিবর্তন করে এসেছ। তুমি যে জামাটা পড়ে এসেছিলে, সেটা কোথা থেকে এনেছ? নিশ্চয়ই অতীত থেকে। তাহলে সেটা কীভাবে করলে?’ রাফিয়া আগ্রহের সুরে জানতে চায়।


রাশেদ সাহেব উত্তরে বললেন, ‘গল্প শুনতে থাকো, উত্তর পেয়ে যাবে।’


গল্প আবার শুরু হলো।


'আমি গাড়ির পেছনে পেছনে পেছনে যাওয়া শুরু করলাম। কাজেই গাড়ির বেগের সাথে আমার বেগ মেলাতে হবে। সেই কাজটাও পারলাম আমি অতি সহজে। গাড়ির সাথে সাথে আমিও পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। গন্তব্য কোথায় জানো? জানলে অবাক হয়ে যাবে সবাই! গন্তব্য ছিলো তোমাদের নানাবাড়ি!


ঠিক সেই মুহুর্তে আমার সব মনে পড়ে গেলো। আজকেই সেই তারিখ, উনিশ বছর আগের যে তারিখে আমার সাথে তোমাদের মায়ের বিবাহ হয়। আজকেই আমাদের উনিশতম বিবাহবার্ষিকী!


সে কথা পরে হবে। যাইহোক। সব মনে পড়ে আমার বেশ দারুন লাগছিলো। নিজের বিয়ের সময়কার কবুল বলার দৃশ্য আবার সামনে থেকে বাস্তব দেখার সুযোগ কয়জন পায়?


আমি আমার জুনিয়রের পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে বাসায় ঢুকছিলাম। ভাবলাম, সবকিছু ভেদ করে যখন চলে যেতে পারি, তখন মানুষ কেন ভেদ করতে পারবো না? আমার ভেতরেই ঢুকে পড়ি, পাশাপাশি কেন হাঁটবো? এই ভেবে যেই নিজের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলাম, অমনি কী যেন একটা অদৃশ্য বল এনে আমাকে আমার জুনিয়রের গভীরে বসিয়ে দিলো। দুজনে একরকম একীভূত হয়ে গেলাম।


আমি নিজের ভেতরে আটকে গেছি। সেই কাজগুলো করছি যেগুলো ঐ সময়ে আমি করছিলাম। সবকিছুর অনুভুতিও পাচ্ছি। হেঁটে হেঁটে ভেতরে গেলাম। দরজায় কড়া নাড়া হলো। তোমাদের নানা হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানালেন।


তারপর আর কী? সব কায়দা-কানুন মেনে শাদী মোবারক সম্পন্ন হলো। আমি জুনিয়রের সাথে একীভূত অবস্থায় থেকে আরো একবার দর্শন নিলাম আমার নিজের বিয়ের।


সেদিন তোমাদের মাকে ওবাড়িতেই রেখে এসেছিলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে সকলে গল্পগুজব করছিলাম। রাত আরো বাড়তে থাকায় বাসায় যাওয়ার জন্য আমার জুনিয়র সোফা ছেড়ে উঠে পড়লো। কিন্তু আমার আরো খানিক বসে থাকতে ইচ্ছা হলো। উঠতে চাইলাম না। শক্ত করে বসে রইলাম। ফলাফল, আমাদের দুজনের বন্ধন আলগা হয়ে গেলো। আমরা পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। সাথে সাথে সোফার সাথেও আমার সংযোগ আলাদা হয়ে গেলো। আমি সোফাতেই বসে আছি, কিন্তু সংস্পর্শে নেই। আবার সেই ভিন্ন মাত্রার প্রাণীর মতো।


তখনই আমি শিখে গেলাম, কীভাবে একীভূত অবস্থা থেকে আবার পৃথক হতে হয়। তার প্রায় সাথে সাথেই একটা শয়তানি বুদ্ধি আমার মাথায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। ঠিক করলাম, বর্তমানে ফেরার সময় এই পাঞ্জাবি-পায়জামা নিয়ে ফিরবো।


তারপর আবার গাড়ির পিছু পিছু বাসায় ফিরছিলাম। ফেরার সময় বিষয়টা নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি। কীভাবে পাঞ্জাবি-পায়জামা তুলে আনা যায়? কেননা, সেখানে আমি এবং আমার উপস্থিতি দুটোই অন্য মাত্রায় জীবের মতো। সহজ ভাষায়, ভুতের মতো। কোনোকিছুকে ছুঁতে পারছি না, সবকিছুকে ভেদ করে চলে যাচ্ছি। তাহলে পাঞ্জাবি-পায়জামাকেও হাতে নিতে পারবো না। আর হাতে নিতে না পারলে, নিয়ে আসা তো দূরের ব্যাপার। তাহলে উপায়।?


অনেকক্ষণ চিন্তা করার পরে বুদ্ধিটা পেলাম। বুদ্ধিটা কী, শোনো তাহলে।


আমি যখন জুনিয়রের সাথে থাকি, তখন কিন্তু জুনিয়র যা কিছু করছে, সবকিছুর অনুভূতি আমার ভেতরে চলে আসে। আমি চাইলেই জুনিয়রকে দিয়ে অন্যকিছু করাতে পারবো না, এতে অতীত পরিবর্তন হয়ে যাবে। কিন্তু জুনিয়র ঐসময় যা যা করছিলো, সবকিছু তো আমিও করছিলাম, সাথে অনুভব করছিলাম। এতে অতীত পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা থাকছিলো না। 


তাই, আমি যদি পায়জামা-পাঞ্জাবি নিয়ে আসতে চাই, তাহলে ওইটা আমার হাতের সংস্পর্শে আসতে হবে। আর তার জন্য আমাকে জুনিয়রের সাথে একীভূত অবস্থায় থাকতে হবে। এবং জুনিয়র যখন পায়জামা-পাঞ্জাবিকে খুলে রাখবে, ঠিক সেই সময়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি ধরে থাকা অবস্থায় আমাকে জুনিয়র থেকে আলাদা হতে হবে। এর ফলেই পায়জামা-পাঞ্জাবি আমার হাতে চলে আসবে। আর আমি ওগুলো নিয়ে বিদায় হতে পারবো।


যেই ভাবা সেই কাজ! বাড়ি ঢোকার আগমুহূর্তেই আমি নিজেকে জুনিয়রের সাথে একীভূত করে নিলাম। বাসায় ঢুকে জুনিয়র পোষাক বদল করলো। তারপর পায়জামা-পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে যেই আলনার ওপর রাখতে যাচ্ছিলো, ওই সময়টাই আমার জন্য মোক্ষম সময়! যেইমাত্র ওগুলো আলনায় রেখে জুনিয়র হাত সরিয়ে নিতে গেলো, ওই মুহুর্তে আমি নিজেকে শক্ত করে স্থির হয়ে গেলাম। ফলাফল, জুনিয়র আমাকে ছেড়ে আলাদা হয়ে অন্য ঘরে চলে গেলো। আর আমি পায়জামা-পাঞ্জাবি আলনার ওপর রাখা অবস্থায় হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছি।


নাদিম জিজ্ঞেস করলো, 'আব্বু, তোমার জুনিয়র যখন পায়জামা-পাঞ্জাবি ছেড়ে অন্য পোষাক পরলেন, তখনই তো তুমি আলাদা হয়ে যেতে পারতে। তখন তো তোমার হাতে ওগুলো ধরা অবস্থায় ছিলোই, তাই না?'


'এর জন্য একটু ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের চিন্তা করার প্রয়োজন পড়ে। তবে দাঁড়াও আব্বু, আমি যতটা সহজ করে সম্ভব বিষয়টা ব্যাখ্যা করছি।


দেখো, যেই মুহুর্তে পায়জামা-পাঞ্জাবি আমার হাতে এলো, সেই মুহুর্ত থেকে কিন্তু ওই সময়কাল থেকে ওগুলো গায়েব। ওগুলো আমার সাথে ভ্রমণ করে ফেললো, এবং আমার সময়কালে চলে এলো। এখন, এই জিনিসটা যদি আমি পোষাক বদলের সময় জুনিয়রের সামনে করতাম, তাহলে জুনিয়র কী দেখতো? দেখতো যে তাঁর চোখের সামনে তাঁর খুলে রাখা পোষাক হাওয়া হয়ে গেলো। এইটা দেখে জুনিয়রের অভিব্যক্তি কেমন হতো, চিন্তা করতে পেরেছো?


তাই, ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক রাখতে আমাকে এই একটু বেশি পরিশ্রম করতে হলো। আমি আলনায় পায়জামা রাখা অবস্থায় আলাদা হয়েছি। আমি যতক্ষণ ওগুলো নিয়ে স্থির, ততক্ষণ ওগুলো ওই সময়ে দৃশ্যমান থাকবে। এবং জুনিয়রের কিছু মনে হবে না। আর জুনিয়র যখন ও ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে গেলো, তখন আমি ধীরে ধীরে ওগুলো সরিয়ে নিলাম। যদিও আমার সামনে ওগুলোর অস্তিত্ব ছিলো, কিন্তু আমি নিশ্চিত, ওই সময়কাল থেকে ওগুলো লুপ্ত হয়ে গেছে। লুপ্ত না হলে ওগুলো দুটো ভার্সন হতো, তাই না? একটা তখনো আলনায় থাকতো, আর একটা আমার হাতে। আর দুটো ভার্সন হওয়া মানেই মাল্টিভার্সের কাহিনী শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু মাল্টিভার্সের যে অস্তিত্ব নেই, তা আমার সমীকরণ আমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে।


তাই আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, পায়জামা-পাঞ্জাবির একটাই ছিলো। এবং এই একটাই যখন আমার কাছে, তখন আলনায় আর কিছু নেই। আমি নিজের সাথে সাথে পায়জামা-পাঞ্জাবিকেও উনিশ বছরের সফর করিয়ে এনেছি। এক্ষেত্রে অতীত পরিবর্তন কিন্তু হয় নি। কেননা আমি উধাও হওয়ার সাথে সাথে ওগুলোও উধাও হয়েছে। ওগুলো আর অতীতে নেই, বর্তমানে আছে। আশা করি, বোঝাতে পেরেছি।


ব্যাস, এইতো। আমি আর অতীতে থাকতে চাইলাম না। তাই গ্যারেজে ঢুকে কারের কাছে এলাম। তারপর সেখানেই পোষাক বদলিয়ে সরাসরি তোমাদের কাছে ফিরলাম।'


‘তারমানে টাইম মেশিন ঠিক ভাবে কাজ করেছে?’ নাদিরা সাহেবা জানতে চান।


‘খবরদার, স্পেসটাইম কন্ট্রোলার কার কে টাইম মেশিন বলবে না।’


‘ঠিক আছে, বলব না। এবার বলো, কাজ করেছে তো?’


‘অবশ্যই করেছে। না করলে এই ভ্রমণ হলো কীভাবে?’


‘তোমার মুখের কথায় তো হবে না! আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই।’


এবার উনিশ বছর পেছনে চলে গেলেন নাদিরা সাহেবা স্বয়ং। তারিখটা এগিয়ে দিয়েছেন। স্থান ঠিক করেছিলেন নিজের বাড়ি। তাই একেবারে উপস্থিত হলেন নিজের ঘরে। যেখানে দেখা গেলো তাঁর জুনিয়র সাহেবা মোবাইল গুতাচ্ছেন। আরো কাছে গিয়ে দেখলেন, ইনবক্স খোলা। প্রাপকের ঘরে তাঁর স্বামী, অর্থাৎ রাশেদ সাহেবের ফোন নাম্বার।


মেসেজ দেখেই নাদিরা সাহেবার মনে পড়ে যায়, বিয়ে ঠিক হওয়ার পরের ঘটনা তখন। তিনি রাশেদ সাহেবকে ‘হ্যালো ডিয়ার’ লিখে মেসেজ করলেন।


এমনকি তাঁর এটাও মনে পড়ে গেলো, রাশেদ সাহেবের রিপ্লাই কী আসবে। রাশেদ সাহেব কেবল একবারই রিপ্লাই দিয়েছিলেন। তাঁর রিপ্লাই ছিলো মোটামোটি এরকম, ‘আপাতত বন্ধু হিসেবে থাকো। এখনই কিচ্ছু না। ধৈর্য্য ধরো, আগে তোমাকে নিজের জন্য হালাল করে নিই। তারপর ডিয়ার, ডার্লিং, হানি, সুইটহার্টসমেত কলিং, চ্যাটিং, ডেটিং সব কোরো। কোনো সমস্যা হবে না। ধৈর্যের ফল মিঠে হয়, জানোই তো!'


আনমনেই হেসে ফেলেন নাদিরা পারভিন । খানিকটা ঠাট্টা করলেও মানুষ হিসেবে তাঁর স্বামী লাখে একজন! স্বামীর প্রতি ভালোবাসাটা তক্ষুনি আরো কয়েক গুণে বেড়ে গেলো তাঁর। 


তার সাথে মায়া হলো জুনিয়র সাহেবাকে দেখে। সে জেগেই থাকলো রাশেদ সাহেবের রিপ্লাইয়ের আশায়। কিন্তু নাদিরা সাহেবা জানেন, জেগে থেকে লাভ নেই খুব একটা। কেননা, রাশেদ সাহেবের রিপ্লাই ভোরের আগে আসবে না। রাত জাগা রাশেদ সাহেবের অভ্যাসের মধ্যে কোনোকালেই ছিলো না। 


একপর্যায়ে, বাধ্য হয়ে যখন তাঁর জুনিয়র সাহেবা বাতি নিভিয়ে শুতে গেলো, তখন রাত তিনটা। সেই সময় নাদিরা সাহেবারও অনুভব হলো, তাঁর স্মৃতি রোমন্থন শেষ। এবার তাঁকে ফিরতে হবে।


মাতা-পিতার ভ্রমণ তো হলো। এবার তিন পর্যটক, যারা কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র, তাদের কাহিনী শুরু হবে। কিন্তু এইখানে নয়, এইখানে আরো কিছু কাহিনী বাকি আছে। সেটা জানার জন্য আমাদের সকলকে এবার উনিশ বছর পিছিয়ে যেতে হবে।


ভাঙতে ভাঙতে সকাল ১০ টায় ঘুম ভাঙলো রাশেদ সাহেবের। এমনিতে খুব সকালে ওঠেন। কিন্তু সেটা সঠিক সময়ে ঘুমোলে, তবে। গত রাতে আর সেটা হয়নি। খুব কষ্ট করে সারা রাত জেগে নতুন বউয়ের সাথে আড্ডা দিতে হয়েছে। তারপর ফজর পড়ে ঘুমাতে গেছেন। সেবার তো হালালের দোহাই দিয়ে বিবিকে ধৈর্য্য ধরিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তো আর সে যুক্তি খাটবে না।


উঠেই দেখেন শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। দেরী করে ঘুম থেকে উঠলে এমন হবেই। গোসল দেওয়া দরকার। কিন্তু গতরাতেই ঘুমানোর আগে গোসল করেছেন। তাতে কী? আজকে এখন আবার করবেন। কিন্তু গোসল করার আগে কালকের পোষাকগুলো ধোয়া দরকার।


সাড়াবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। কিন্তু পোষাক বাবাজী কোথায় গা ঢাকা দিয়েছে, কে জানে? যখন খুঁজে পাওয়া গেলই না, তখন মাথায় রক্ত চড়ে উঠলো। বিয়ের সাধের পায়জামা-পাঞ্জাবি। চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করলেন। তাতেও যখন শান্তি পেলেন না, তখন শেষমেষ রেগেমেগে পুলিশের কাছে গিয়ে রিপোর্ট লেখালেন।


এমনকি কড়া একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। চোরকে হাতে পেলে তার পিঠের উনিশটা লাঠি ভাঙবেন। কিন্তু তিনি জানেন কি, চোরটা স্বয়ং তিনিই!!


আবার বর্তমানে ফিরে আসা যাক।


গতরাতে গল্প শোনানোর পর আবার বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে ছেলেমেয়ে কর্তৃক আয়োজিত ফ্যামিলি পার্টিতে যোগ দিতে হয়েছে রাশেদ সাহেবকে। ক্লান্ত হয়ে গেছেন রাশেদ সাহেব। কিন্তু পরেরদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়নি তাঁর। সকাল সকাল উঠে ফজরের নামায আদায় করলেন। একটা বিস্কুট পেটে গেলো তারপর। এবার বের হবেন হাঁটতে। রোজ সকালে হাঁটেন তিনি। কিন্তু যে জার্সি পরে হাঁটতে বের হন, সেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না।


বিবিকে সাথে নিয়ে পুরো বাড়ি খোঁজা হলো। তবুও সাধের জার্সির পাত্তা মিলল না। রাশেদ সাহেব তো রেগে অস্থির।


‘সারাবাড়ি খোঁজা হলো, কোত্থাও নেই। নির্ঘাত চুরি হয়েছে। কে? কোন বাপের ব্যাটা চুরি করেছে আমার জার্সি?’


‘তুমি কালকেও তো পরে বের হলে। আর আজকেই পাওয়া যাচ্ছে না। আজব কাণ্ড!’


‘যে নিয়েছে আমার জার্সি, তাকে পেলে আমি ছাড়বো না।’


‘আচ্ছা, এমনটা নয় তো? হয়তো সে-ই নিয়েছে।’


‘কে? কে? ব্যাটার নামটা একবার বলো, বিবি।’


‘জনাব রাশেদ শাহেদ!!’


‘কী? আমি? আমি আমার জার্সি চুরি করেছি? কী সব আবোল-তাবোল বলছ?’


নাদিরা সাহেবা মুচকি হাসলেন। তারপর স্বামীর কাছে ঘেষে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কেন রে তিন বাচ্চার আব্বু, এই পাগলিটার একান্ত প্রিয়তম? তুমি তো অতীত থেকে তোমার পাঞ্জাবি-পায়জামা চুরি করে, না মানে, উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলে। এমন কি হতে পারে না, হয়তো ভবিষ্যৎ থেকে স্বয়ং তোমার সিনিয়র তুমি এসেই তোমার জার্সি উঠিয়ে নিয়ে গেছো!’





কাহিনী শেষ



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)