অবুঝ কাউয়া

0

 

    একবার এক চড়ুই একটা গাছের নিচে পোকামাকড়ের খোঁজ করছিলো। হঠাৎ সে দেখতে পেল, ঐ গাছের ডালে কী যেন একটা জ্বলজ্বল করছে। চড়ুই ওইখানে গেল উড়ে উড়ে। গিয়ে দেখে, একটা সোনার বাটি। বাটির ভেতরে অবশ্য কিছু ছিলো না। চড়ুই ভাবল, এই বাটি আমার আর কী কাজে লাগবে? কোনো মানুষের হাতে পড়লে না হয় সে এটার দ্বারা উপকৃত হতো। কিন্তু আমি এই বাটি নিয়ে কী করবো? এই ভেবে চড়ুই ওখান থেকে উড়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার ডানার সাথে ধাক্কা লাগল বাটিটার। তার ফলে বাটিটি নিজের জায়গা থেকে পড়ে গেলো। মাটিতে পড়লো উপুড় হয়ে। চড়ুই সবকিছু ওপর থেকে দেখছে। বাটির নিচের মাটি ধীরে ধীরে সাদা হয়ে যাচ্ছে। কী আজব কাণ্ড? সে যখন বাটিটাকে দেখলো তখন তো বাটিতে সাদা কিছুই ছিলো না।

চড়ুই নিচে নেমে এসে বাটিটাকে চিত করলো। দেখলো, বাটি দুধে ভর্তি। আর বাটির নিচে দুধের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। চড়ুই বেশ অবাক হলো। এ তো দেখি জাদুর বাটি! চিত করে রাখলে বাটিতে কিছুই নেই। কিন্তু উপুড় করলেই বাটি থেকে দুধ পড়ে। আজব কাহিনী! চড়ুই বাটিটাকে নিজের বাসায় নিয়ে এলো।

দিনে দিনে পুরো জঙ্গলে এই কাহিনী রটে গেলো। চড়ুই নাকি আজব এক বাটি পেয়েছে। সেই বাটি উপুড় করলেই দুধ পড়ে। আর দুধ পড়া শেষই হয় না! সবাই এসে সেই দুধের স্বাদ চেখে দেখে গেছে। দুনিয়ার সবচেয়ে উতকৃষ্ট গরুর দুধ থেকেও উৎকৃষ্ট এই দুধ। একবার স্বাদ না নিলেই নয়।

সবার কাছে থেকে খবর পেতে পেতে এক কাক এলো সেই দুধের স্বাদ নিতে। কাকের নাম কাউয়া। কাউয়া খুবই বোকা। সব কাক তাকে খ্যাপায়। তবুও কাউয়া সংশোধিত হয় না। সেই কাউয়া গেলো চড়ুইয়ের দুধের স্বাদ নিতে। চড়ুইয়ের বাসায় উপস্থিত হলো।

‘চড়ুই চাচী, ও চড়ুই চাচী। বাড়ি আছ?’

‘ও, কাউয়া এসেছ। এসো এসো, ভেতরে এসো।’

‘তা চাচী, সবাইকেই তো দুধ খাওয়ালে? আর আমি বাকি থাকি কেন? আমাকেও খাওয়াও।’

চড়ুই ভেবে দেখলো, কাক হচ্ছে সেই লোক যে রাজ্যের সব আবর্জনা চেখে দেখে। আর আমি যদি একে দুধ পান করতে দিই, তাহলে এ তো বাটির বারোটা বাজিয়ে ফেলবে। সবকিছু ভাবার পর চড়ুই বলল, ‘তাহলে ভাতিজা, তুমি এক কাজ করো। তোমার ঠোঁট দুটো একটু ধুয়ে এসো। জানই তো, ঠোঁট না ধুয়ে কোনো খাবার মুখে নিতে নেই।’

কাউয়া তখন দুধ খাওয়ার জন্য এতই উতলা ছিলো যে বেশিকিছু না ভেবে সে বলল, ঠিক আছে চাচী। আমি এখনই যাচ্ছি।

কাউয়া উড়তে উড়তে একটা নদীর সামনে উপস্থিত হলো। কলকল ধ্বনিতে বয়ে যাচ্ছে ঢেউ। কাউয়ার খুব ভালো লাগলো। সে নদীর কাছে গিয়ে বলল,

‘নদী ভাই, নদী ভাই

দিবে পানি

ধুইবো ঠুট

ত্যানেগা খাব চড়ুইয়ের দুধ।’

(বিঃ দ্রঃ গল্পটির ছন্দ মেলানোর জন্য আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। তোমরা নিজ দায়িত্বে বুঝে নিও। উল্লেখ্য, এখানে, ঠুট = ঠোঁট, ত্যানেগা = তাহলে)

নদীও চড়ুইয়ের মতো একই কথা ভাবল। কাক তো গোটা দুনিয়ার আবর্জনা সাফ করে এসেছে। এখন সে যদি আমার পানিতে ঠোঁট ধোয়, তাহলে আমার সব পানি দূষিত হয়ে যাবে। তাই নদী বলল, তুমি আগে একটা ঘটি নিয়ে এসো। সেই ঘটিতে পানি তুলে তারপর ঠোঁট ধুয়ে নিও।

কাউয়া হাজির হলো কুমারের কাছে। কুমারের কাছে গিয়ে সে বলল,

‘কুমার ভাই, কুমার ভাই

গড়াবে ঘটি

তুলব পানি

ধুইবো ঠুট

ত্যানেগা খাব চড়ুইয়ের দুধ।’

কুমার বলল, ‘তাহলে আমাকে একটু মাটি এনে দাও। মাটি না পেলে আমি ঘটি বানাবো কী দিয়ে? যাও, মাটি নিয়ে এসো। মাটি দিয়ে ঘটি বানিয়ে দিচ্ছি।’

একটা ফসলি জমির কাছে গিয়ে কাউয়া বলল,

‘জমি ভাই, জমি ভাই

দিবে মাটি

গড়াবো ঘটি

তুলব পানি

ধুইবো ঠুট

ত্যানেগা খাব চড়ুইয়ের দুধ।’

জমি বলল, ‘আমার কি নিজে মাটি দেওয়ার মতো ক্ষমতা আছে? তুমি নিজে তুলে নিয়ে যাও।’ কাউয়া দেখল মাটি শক্ত হয়ে আছে। তার পায়ের নখের বা ঠোঁটের গুঁতোতে মাটি উঠবে না। তাই সে ভাবল যে মাটি তোলার জন্য শক্ত কিছু একটা লাগবে। অনেক ভেবে ভেবে সে মহিষের কাছে গেলো।

মহিষের কাছে গিয়ে কাউয়া বলল,

‘মহিষ ভাই, মহিষ ভাই

দিবে শিং

তুলব মাটি

গড়াবো ঘটি

তুলব পানি

ধুইবো ঠুট

ত্যানেগা খাব চড়ুইয়ের দুধ।’

মহিষ বলল, ‘কী? এত বড় কথা? আমার শিং নিবি? তুই আমার শিং নিবি? দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি মজা।’ এই বলে মহিষ কাউয়াকে তাড়া করতে শুরু করলো। মহিষের তাড়া খেয়ে কাউয়া উড়তে উড়তে পৌঁছে গেল এক কুকুরের বাসায়। কুকুরের কাছে গিয়ে সে বলল,

‘কুকুর ভাই, কুকুর ভাই

ধরবে লড়াই

ভাঙবে শিং

তুলব মাটি

গড়াবো ঘটি

তুলব পানি

ধুইবো ঠুট

ত্যানেগা খাব চড়ুইয়ের দুধ।’

কুকুর বলল, ‘অনেকদিন ধরে অসুস্থ, ভাই। গায়ে অতো শক্তি নাই। কিন্তু মজার কথা হলো, গাভির দুধ খেলে আমার শরীরে এক নিমিষে শক্তি চলে আসে। তুমি যদি কোনো গাভির কাছ থেকে একটু দুধ এনে দিতে পারো, তাহলে বেশ ভালো হয়।’ 

একটা গাভীর কাছে গিয়ে কাউয়া বলল,

‘গাভী ভাই, গাভী ভাই

দিবে দুধ

খাবে কুকুর

ধরবে লড়াই

ভাঙবে শিং

তুলব মাটি

গড়াবো ঘটি

তুলব পানি

ধুইবো ঠুট

ত্যানেগা খাব চড়ুইয়ের দুধ।’

গাভী বলল, ‘দেখো, এই জমিতে একটাও কচি ঘাস নেই। আমাকে কচি ঘাস এনে দিতে পারবে? তাহলে সেগুলো খেয়ে আমি আরো তাড়াতাড়ি দুধ দিতে পারব।’

ঘাসের কাছে গিয়ে কাউয়া বলল,

‘ঘাস ভাই, ঘাস ভাই

দিবে ঘাস

খাবে গাভী

দিবে দুধ

খাবে কুকুর

ধরবে লড়াই

ভাঙবে শিং

তুলব মাটি

গড়াবো ঘটি

তুলব পানি

ধুইবো ঠুট

ত্যানেগা খাব চড়ুইয়ের দুধ।’

ঘাস বলল, ‘যাও। একটা কাঁচি নিয়ে এসো। তারপর যত পারো ঘাস কেটে নিয়ে যাও। ওহ, এত পরিমাণ ঘাস হয়েছে যে আমি আর এর ভার সহ্য করতে পারছি না। তাড়াতাড়ি কেটে আমাকে হালকা করো।’

এক কামারের কাছে গিয়ে কাউয়া বলল,

‘কামার ভাই, কামার ভাই

গড়াবে কাঁচি

কাটব ঘাস

খাবে গাভী

দিবে দুধ

খাবে কুকুর

ধরবে লড়াই

ভাঙবে শিং

তুলব মাটি

গড়াবো ঘটি

তুলব পানি

ধুইবো ঠুট

ত্যানেগা খাব চড়ুইয়ের দুধ।’

কামার বলল, ‘সবকিছুই তৈরি আছে। কিন্তু আগুন নাই। একটু আগুন এনে দিতে পারবে?’

এক গেরস্থের বাসায় গিয়ে কাউয়া দেখলো ও বাড়ির বউ চুলা ধরাচ্ছে। তার কাছে গিয়ে বলল,

‘বৌদি ভাই, বৌদি ভাই

দিবে আগুন

গড়াবো কাঁচি

কাটব ঘাস

খাবে গাভী

দিবে দুধ

খাবে কুকুর

ধরবে লড়াই

ভাঙবে শিং

তুলব মাটি

গড়াবো ঘটি

তুলব পানি

ধুইবো ঠুট

ত্যানেগা খাব চড়ুইয়ের দুধ।’

শেষ পর্যন্ত গৃহিনী কিছুই চাইলো না। সে বলল, ‘আগুন নিবে? তাহলে নাও। কিন্তু কিসে নেবে?’

‘আমার পাখায় দাও।’

‘পাগল হয়েছ? পাখায় দিলে পাখা তো পুড়ে যাবে।’

‘ওহ, তাহলে তো এটা খুব চিন্তার বিষয়।’

‘চিন্তা কোরো না। আমি উপায় বলছি।’

গৃহিনী বউটি গিয়ে একটা শোলা (পাটকাঠি) নিলো। তার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো। আর অন্য মাথায় একটা কাপড় ভালো করে পেঁচিয়ে কাককে বলল, ‘এই নাও। এই কাপড়ের ওপর ধরবে। সাবধানে নিয়ে যেও কিন্তু।’

‘তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ বৌদি ভাই।’

কাউয়া উড়ে গেলো। এক উড়াতে পৌঁছে গেলো কামারের বাসায়। কামার আগুন পেয়ে খুব খুশি। নিজের সব কাজের তদারকি করে খুব দ্রুত কাউয়াকে কাঁচি বানিয়ে দিলো। কাউয়া সেই কাঁচি নিয়ে গিয়ে ঘাস কাটল। সেই ঘাস নিয়ে গিয়ে গাভীকে দিলো। গাভী ঘাস খেয়ে দুধ দিলো। সেই দুধের বালতি নিয়ে এসে কাউয়া কুকুরকে দিলো। কুকুর দুধ খেয়ে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলো। তার গায়ে আগের মতো বল ফিরে এলো। কাউয়া তাকে নিয়ে মহিষের কাছে গেলো। কুকুরের সাথে মহিষের লড়াই হলো খানিক্ষণ। লড়াইয়ে মহিষের দুটো শিং-ই ভেঙ্গে গেলো। কাউয়া একটা শিং নিয়ে এসে মাটি তুলল। মাটি তুলে এনে কুমারকে দিলো। কুমার এক নিমিষে একটা ঘটি বানিয়ে রোদে শুকাতে দিলো। কিন্তু কাউয়ার আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না। কুমারের বারণ সত্ত্বেও সেই ঐ ভেজা নরম ঘটি নিয়ে নদীর কাছে গেলো। আর নদীর পানি ঘটির মধ্যে নিতেই......।

ঘটি একেবারে গলে ঝোল হয়ে গেলো! কাউয়ার খুব মন খারাপ। মনে পড়লো কুমার তাকে বলেছিলো, ‘আরে, এই অবস্থায় ঘটি নিয়ে কোনো কাজ করা যাবে না। কাজ করতে গেলেই ঘটি ভেঙ্গে যাবে।’

খুব মন খারাপ কাউয়ার। ব্যর্থ মনে ফিরে এলো সে চড়ুইয়ের কাছে। চড়ুই তাকে জিজ্ঞাসা করলো, ঠোঁট ধুয়ে আসতে এতক্ষণ লাগে? জবাবে কাউয়া তাকে সব কাহিনী খুলে বলল। চড়ুই তো সেই কাহিনী শুনে হাসতে হাসতে মরে। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে কাউয়াকে বলল, ‘অনেক হয়েছে। যাও, গাছের ঐ নিচু ডালটায় বসে আকাশের দিকে মুখ করে হাঁ করো।’

চড়ুইয়ের কথামতো কাউয়া নিচের ডালে গিয়ে হাঁ করলো। চড়ুই তার সোনার বাটি কাত করে সব দুধ কাকের মুখ লক্ষ্য করে ঢালতে লাগলো। কাউয়ার তৃষ্ণা মিটে গেলো। এমন দুধ সে তার জীবনে কখনো খায় নি!

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

কাহিনী শেষ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)