শীতের সকাল।
আহা, কী মৃদু মৃদু
ঠান্ডা হাওয়া! সবারই ভালো লাগে। আমাদেরও। বার্ষিক
পরীক্ষার পর শীতের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। এবার হাতে কোনো কাজ নেই। কী আর করি আমরা
পাঁচ জন। কাজ আছে কেবল একটাই। আহমেদ ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসে সবাই মিলে আড্ডা
দেওয়া। তাই আমি প্রথম গিয়ে আহমেদ ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসলাম। দোকানে বিশেষ কোনো
লোকজন নেই। থাকারও কথা না। সবাই জানে এবার আমরা এখানে আসব। আর আমাদের আড্ডা শোনার
অনুমতি কেবল আহমেদ ভাই ছাড়া আর কারোরই নেই।
একে একে সবাই এলো। প্রথমে এলো ভোম্বল ভুঁইয়া ওরফে বোম। ওর
দেহের আকারের সোয়েটার এ মুল্লুকে পাওয়া যায় না। তাই বিশাল একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে
এসেছে। তারপর এলো পাপ্পু হাসান ওরফে পেঁপে ভাইয়া আর নয়ন খান ওরফে ন্যাড়া। একসাথে।
পাশাপাশি বাড়ি তো। আর সবার শেষে টলতে টলতে এলো খ্যাপাচরণ মজুমদার ওরফে খেপু।
ব্যাটার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে নিজের ইচ্ছায় ঘুম থেকে ওঠেনি। জোর করে কেউ টেনে
তুলেছে।
তো সব বান্দা হাজির। এবার আর থেমে থাকি কেন? দুধ-চা আর বিস্কুট নিয়ে শুরু হলো আড্ডা। প্রথমেই পেঁপে ভাইয়া বলে উঠলো, 'তোরা সবাই আমাকে একটা ইডাইয়া দে তো। তোদের তো ছুটি শুরু হলো। এতদিন ছুটি। এতদিন কি রাস্তায় বসে বসে মোগলাই সোল্ড করবো?'
পেঁপে ভাইয়ার ইংরেজি তো ন্যাড়ার অসহ্য। তাই দ্রুত বলে ফেলল, 'ইডাইয়া নয়, কথাটা হবে idea। সোল্ড বলে পাস্ট টেন্স বানানোর দরকার নেই, sell বললেই চলবে। আচ্ছা, সে-সে-সেটা থা-থা-থাক। চ-চ-চ-চলো কোথাও বেড়াতে যাই। যেমন কুয়াকাটা, জাফলং, ককক--'
ন্যাড়া আটকে গেছে। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কক্সবাজার?'
ন্যাড়া মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জবাব দিলো।
কিন্তু পেঁপে ভাইয়া ভীষণ বিরক্ত। না জানি কোন বেয়াড়া মার্কা কারনে কক্সবাজারের ওপর খেপে আছে। বলল, 'আরে ধুর! ঐ সব জায়গায় কি মানুষে যায়? অন্য কিছু টেল কর।'
ইতোমধ্যেই আমাদের বোম মহাশয়ের প্রস্তাব, "চলো দিনাজপুরে যাই। ওইহানে আমার মামা থাকে। ওইখানে কয়েকদিন থাইক্যা পোলাও-মাংস সাটাইয়া আসা যাইবো।"
বোম শেষ বাক্যটা না বললে হয়তো পেঁপে ভাইয়া এই প্রস্তাবটিও নাকচ করে দিতো। কিন্তু পোলাও-মাংসের কথা যখন এসে গেছে, তখন পেঁপে ভাইয়ার মতো ভোজনরসিক মানুষ কি আর বসে থাকতে পারে? অবশ্যই পারে না। তাই বলে উঠলো, 'ওটাই ফিনালে। শুনেছি দিনাজপুর বেশ ফাইন জায়গা। আর নাকি বেড়ানোর জন্য জন্য খুব ফাইন ফাইন পিলেস আছে। চল, ওখানেই যাবো।'
ন্যাড়া আবার ভুল ধরে। শোধরাতে গিয়ে বলে, 'ফিনালে আর পিলেস নয়। কথাগুলো
হবে final and place।' এটুকুতেই পেঁপে
ভাইয়ার একটু বিরক্তি আর অনেকখানি রাগ যুক্ত 'থাম' নামক এক ঝাড়ি তাকে খেতে হয়।
আমি খুব ভালো করেই জানি, সুন্দর জায়গা দেখতে যাওয়ার নাম করে যতই আমাদের ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, আমাদের পেঁপে ভাইয়া পোলাও-মাংস গিলতেই ওখানে যাচ্ছে। সেটা মুখে বলার সাহস করলাম না। কেন যাবে, সেটা না বলে কীভাবে যাবে, সেটা বলাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাই বললাম, 'যাওগে কেইসে, মানে যাবে কীভাবে?'
পেঁপে ভাইয়ার সটান উত্তর, 'অফ কোউর্স, ট্রেনে গো করবো। তোরা তো জানিস, দূরে কোথাও যেতে গেলে আমি ট্রেনে করেই গো করবো। ট্রেন ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে গো করার হাবাইট আমার নেই।'
ন্যাড়া ফের ভুল ধরে, 'habit, habit।'
২
আমরা সবাই তৈরি।
বাড়ি থেকে অনুমতি নিতে কোনো কষ্ট হয়নি। আমাদের ট্রেন ছাড়বে
সন্ধ্যা ৭ টায়। তাই আমরা স্টেশনে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হলাম ৬ টায়। কিন্তু, খেপু গেছে ওর পিসির (ফুফু)
বাড়ি। আমাদের ট্রেনটা যে রেলপথ দিয়ে যাবে, ওটা খেপুর পিসির বাড়ির কাছেই। ওখানকার স্টেশনে ট্রেন থামলেই
তুলে নেওয়া হবে খেপুকে। আমরা আমাদের ব্যাগপত্র নিয়ে স্টেশন পৌঁছলাম ৭টা বাজার ২০
মিনিট আগে। ট্রেনে ওঠার পরই পেঁপে ভাইয়া তার অতি বিখ্যাত ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করে
দিলো। বলল, Ôআমার বড্ড হাঙর পেয়েছে রে। কিছু একটা এয়াট করা আমাকে।Õ
আমি বুঝতে পারিনি। বললাম, Ôঅ্যাঁ? এইটা আবার কোনসি ভাষা হে, মানে কোন ভাষা?
ন্যাড়া উত্তর দিয়ে দিলো, Ôপেঁপে ভাইয়ার হাঙরের স-স-স-সমান খি-খি-খি-ক্ষিদে পেয়েছে না? তাই hungry বলতে গিয়ে হাঙর বলে ফে-ফে-ফেলেছে। আর পেঁপে ভাইয়া, এয়াট নয়। কথাটা হবে eat।Õ
আমি হাফ ছাড়লাম, Ôও তাই বলো। আমি তো বহুত ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।Õ
পেঁপে ভাইয়া এবার ভুল শোধরানোর পরের রাগ দেখায়নি। খিদের
কাছে সব জোর হার মেনে যায়। ভাইয়া বলল, Ôন্যাড়া, কিছু একটা খাওয়া।
নাহলে আমি পটল লিফট করবো।Õ
ইতোমধ্যেই বোম মাঝখান থেকে পেঁপে ভাইয়াকে চটিয়ে দিয়ে বলল, Ôপিপে ভাইয়ার প্যাট হচ্চে গিয়া
এক নাম্বারের গুদামঘর। তোমরা রোসো, রোসো। গুদামঘর বন্দ করণের ব্যবস্থা আমার জানা আছে। ন্যাড়া, যেইখান থাইক্যা পারিস, একটা পাম্পার লইয়া আয়। পেঁপে ভাইয়ারে খানিক পাম দেই। তাইলেই ঠিক হয়্যা যাইবো।Õ
পেঁপে ভাইয়ার গর্জনাকার উত্তর, Ôশুট আপ, বোম। নাহলে তো মাউন্টেন প্রুফ ভুড়ির ওপর টু
হান্ড্রেড অ্যান্ড ফোর্টি ফাইব কিলো পাওয়ারের
একটা পুঞ্চ মারবো।Õ
ন্যাড়া আমাদের বুঝিয়ে দেয়, Ôজে-জে-জে-জেনে রাখা ভা-ভা-ভা-ভালো যে, মাউন্টেন প্রুভ
ভুড়ি মানে
হলো পর্বতপ্রমাণ ভুড়ি। আরো যে দুটো ভুল পেঁপে ভাইয়া
করেছে,
তা হলো শুট আপ আর পুঞ্চ, অর্থাৎ shut up and punch।Õ
পেঁপে ভাইয়া এবার ছন্দ মেলাতে শুরু করেছে। বলে ফেলল, Ôবোমের বাচ্চা বোম, আজ তোরে দেখাবো যম।Õ
Ôন্যাড়া ন্যাড়া, দাঁড়া দাঁড়া। আর
পাম্পার আননের দরকার নাই। আমাদের পেঁপে ভাইয়া এমনিতেই হাই লেভেলের পাম খাইয়া কবি
হইয়া বইসা আছে। আরও বেশি পাম দিলে আবার ফাইট্ট্যা যাইতে পারে।Õ
Ôআজ তুই ফাইনিশ।Õ
এই বলে যেই পেঁপে ভাইয়া বোমকে মারতে আসলো, অমনি বোম লাফিয়ে
সিটের ওপর উঠে পড়লো। সিট বেচারা বোমের ওজন সহ্য করতে না পেরে ক্যারক্যার শুরু করে
দিলো।
আর ঠিক এই সময় কোথা
থেকে একটা লাঠি এসে পড়লো একেবারে পেঁপে ভাইয়ার ঘাড়ের ওপর। অমনি পেঁপে ভাইয়া চিৎকার
দিয়ে উঠেছিলো। তখনই পেঁপে ভাইয়ার ঘাড়ের ওপর আরেকটা চাটি পড়লো। পেঁপে ভাইয়া এবার আর
চিৎকার না দিয়ে ঘাড় ডলতে ডলতে পেছন ফিরে তাকালো। আর যা দেখলো তাতে তার মুখ থেকে
কথা যেন হাওয়া হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও।
দেখা গেলো জায়নামাযে বসে আছে এক মোল্লা,
গায়ের পাঞ্জাবিটাও তেমনি ঢোল্লা।
মুখে আছে কাঁচাপাকা বেশ লম্বা দাঁড়ি,
পাশে অবস্থান করছে একটা স্টীলের হাঁড়ি।
আগুনের মতো তার চেহারা,
মাথার চুলগুলোও বেশ খাড়া খাড়া।
আঁকাবাঁকা রঙে আঁকা তার টুপি
তছবি পড়ছেন ধীরে ধীরে চুপি চুপি
হঠাৎ তছবি পড়া হলো শেষ
তাকালেন চোখে নিয়ে একরাশ বিদ্বেষ।
মোল্লা বলে উঠলো, Ôকী শুরু করেছ তোমরা? একটু শান্তিতে কি এশার নামাযটাও পড়তে
পারবো না? কোন দুঃখে যে এই কামরার টিকিট কিনলাম। এবার দেখছি জান জ্বালিয়ে খাবে।Õ
পেঁপে ভাইয়া এদিকে চিল্লাচ্ছে, Ôও মামারে, ও চাচারে, জ্বলে গেলো রে। ঘাড়ের হাড্ডি ডেস্ট্রয় হয়ে গেলো রে। এত প্যান কেন হচ্ছে রে?Õ
ন্যাড়া ফিসফিস করে বলে, Ôপ্যান নয় ভা-ভা-ভা-ভাইয়া। ক-ক-কথাটা হবে pain।Õ
মোল্লা আবার বলে ওঠে, Ôহয়েছে হয়েছে। আর দেখাতে হবে না। যেন ব্যাথায়
একেবারে মরে যাচ্ছে!! মুখ দিয়ে আবার কী
সব আজেবাজে ভাষা বের করেছে। শোন রে ছেলে, তোমার মতো অনেক মার খেয়েছি ওস্তাদের হাতে। হাড় ভেঙ্গে একেবারে গুড়ো করে দিতেন।
তাতেও আমি পটল তুলতাম না। মাত্র একদিন হাসপাতালে থেকে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতাম।
হাহাহা,
একেই বলে, আল্লাহ মেহেরবান, তো হুজুরও পালোয়ান।Õ
পেঁপে ভাইয়ার চোখ মুখ দেখে মনে হলো মোল্লার কথা শুনে আকাশ
থেকে পড়েছে। বলল, Ôতাহলে তো আপনি লৌহমানব হুজুর। আপনার পা কোথায়? দেখি, একটা সালাম করি।
কিন্তু হুজুর, আপনার নামটা কী?Õ
পেঁপে ভাইয়ার ব্যবহারে সবাই অবাক হলেও আমি অবাক হলাম না।
কারণ আমি খুব ভালো করে ভাইয়াকে চিনি। যে লোক ভাইয়াকে কোনোভাবে হেনস্থা করবে বা
ব্যাথা দেবে, আগে তার কাছে ও সবার চেয়ে ভালো হয়ে
উঠবে। এমন ব্যবহার শুরু করবে যেন ঐ লোকটি পেঁপে ভাইয়াকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা
শুরু করে। তারপর সুযোগ পেলে লোকটির এমন অবস্থা করবে যেন ও আর কোনোদিন পেঁপে
ভাইয়াকে না ঘাটায়। একেবারে নাজেহাল করে ছাড়বে।
মোল্লা বলল, Ôইয়ে, আমার নাম মোল্লা
খুশখুশাউল্লাহ!!Õ
Ôঅ্যাঁ! খু-উ-উ-উ-শ খুশা উল-উ-ল্লাহ!!Õ
Ôএতেই ভয় পেয়ে গেলে। আমার যিনি
হুজুর ছিলেন, তার নাম কী ছিলো জানো?Õ
মোল্লা ঢাক বোমা পট্টকানুল্লাহ
তার হুজুরের নাম ছিলো
মোল্লা পায়রা ডিম্ব ভর্জনপূর্বক চর্বনুল্লাহ
তার হুজুরের নাম ছিলো
মোল্লা তরমুজাংগি ভক্ষণ নাহি পুরতন খর্বনুল্লাহ
তার হুজুরের নাম ছিলো
মোল্লা ঝিঙ্গাবীজ কর্তন সমগ্র খর্বন খরতন
চোষ্যজাতুল্লাহ
তার হুজুরের নাম ছিলো...............
আমি বলে উঠলাম, Ôআর বলবেন না। হুজুর খুশখুশাউল্লাহ, এতেই আমার দম আটকে আসছে। এরপর হার্টফেল কারুংগা।Õ
Ôহা হা হা। হাসালে তুমি। তোমার এই কাজে খুশি হয়ে তোমাদের এই গবেটকে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তোমরা কোথা থেকে আসছো? নাকি কোথাও যাবে?Õ
পেঁপে ভাইয়া ধীরে ধীরে বলেছে যে সেও নাকি মোল্লাকে মাফ করে দিয়েছে। সেটা কেবল আমার কানে পৌঁছলো। তারপর জোরে জোরে একে একে আমাদের সবার পরিচয় দিয়ে বলল, Ôহুজুর, আমরা দিনাজপুরে যাচ্ছি। মামার বাড়ি। সেখানে একটু দাওয়াত আছে আর কি।Õ
Ôও আচ্ছা, বেশ বেশ। আমি নামবো জয়পুরহাট। ওখানে আমার এক ছাত্র মাদ্রাসা খুলেছে। তাই দেখতে যাচ্ছি।Õ
Ôওহ, বুঝলামÕ।
Ôকিন্তু এবার যে আমার আল্লাহর
ধ্যানের সময় হলো।Õ
Ôআপনি এখানে বসেই আল্লাহর ধ্যান
করবেন?Õ
Ôহ্যাঁ করব। কেন নয়? আমি তো ঘুমাই না, কেবল চোখ বুজে থাকি মাত্র। আর চোখ বুজে আমি আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যাই। সবাই ভাবে যে, আমি হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছি। কিন্তু আমি আসলে ঘুমাই না। তোমরা শুনে হয়তো আশ্চর্য হয়ে যাবে যে, আমি গত ৩৫ বছরে একবারও ঘুমাইনি।Õ
ন্যাড়া আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, Ôমিথ্যা বলছে নসু ভাই। মা-মা-মানুষ না ঘুমিয়ে ১০ দিনের বেশি থাকতেই পারে না। আরে এ বলে কিনা ৪৫ বছর ঘু-ঘু-ঘু-ঘুমায়নি।Õ
আমিও ন্যাড়ার কানে কানে বললাম, Ôআমার আগে থেকেই সন্দেহ ছিল। কুছতো গড়বড় হে। কিউকি হাম যাব মোল্লাকে প্রথমবার
দেখলাম, তখন কি বলেছিল
শুনেছিস? বলেছিল যে সে
নাকি এশার নামাজ পড়লো। কিন্তু এখনো ৩০ মিনিট
পরে এশার আজান হবে। আর এই ব্যাটা পেহেলেছে নামাজ পড়লিয়া।Õ
মোল্লা আমাদেরকে বলল, Ôতোমরা দুজন কী বলাবলি করছো?Õ
ন্যাড়া দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, Ôকিছু না হুজুর। আসলে আমরা ভা-ভা-ভাবছিলাম আরো কী কী করলে আপনার উপকার করতে পারবো।Õ
Ôবেশি কিছু না। শুধু হইহুল্লা
একেবারে বন্ধ রেখ।Õ
পেঁপে ভাইয়া আবার মুখ খোলে, Ôচিন্তা করবেন না হুজুর। আপনাকে আমরা একেবারেই ডিশটাপ করবো না।Õ
ন্যাড়া শুধরে দেয়, Ôডিস্টার্ব, ডিস্টার্ব ।Õ
মোল্লা নরম গলায় বলে, Ôআর পারলে তোমার এই ভাষাগুলো
আমার কানের কাছ থেকে দূরে রেখ। আর না হলে শুদ্ধ বাংলায়
কথা বল। দেখো, তোমার বন্ধুটি তো আমাকে শেখানোর জন্য কত চেষ্টা করছে। আর তুমি যদি একটু কষ্ট করে ওগুলো নিজের আয়াতের মধ্যে আনতে
পারো, তাহলে কত না ভালো হয়! তাহলে আর তোমার বন্ধুর কষ্ট করে তোমার ইংরেজি গুলোকে ঠিক করে দিতে হবে না।Õ
সব্বাই বুঝতে পারলো যে পেঁপে ভাইয়া মোল্লার উপর চরম ক্ষেপে
আছে, আর মোল্লাকে শায়েস্তা করতে কিছু একটা অবশ্যই করবে।
বোম বলল, Ôতে আপনে কি মিষ্টি কতা কইতে পারেন না? যখন থাইক্যা আপনের
কতা শুনতাছি, খালি মনে হইতেছে ঝাল লাগতাছে, একটু মিষ্টি কইর্যাও তো কতা কওন যায়,
নাকি?Õ
Ôকারন আমি ২৫ বছর যাবত স্পর্শ
করিনি। মিষ্টি খেতে আমার
একেবারেই ভালো লাগে না। কেমন যেন, আরে, থু!Õ
ন্যাড়া আবার আমার কানে কানে, Ôএ ভাই, মিষ্টি খাওয়া সুন্নত না?Õ
আমি জবাব দেওয়ার আগে পেঁপে ভাইয়া বলে উঠলো, Ôওখেই হুজুর। আপনি কুইকলি লং হয়ে লাই করুন।Õ
মোল্লা থমথম খেয়ে গেছেন। বললেন, Ôকী বললে তুমি? লং হয়ে লাই? এই যে তুমি, নয়ন
না কী যেন নাম। তুমি তো ওর
ইংরেজি ভালোই ধরতে পারো। যদি একটু অনুবাদ করে দাও, তাহলে বড় ভালো হয়।Õ
Ôহুজুর, আপনি নিশ্চয়ই জানেন quickly মানে তাড়াতাড়ি। long মানে লম্বা আর lie মানে হয় শুয়ে পড়া। ভাইয়া আপনাকে কুইকলি লং
হয়ে লাই করতে বলেছে, মানে তাড়াতাড়ি লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে ব-ব-ব-Õ
Ôউহ, তোমাদের এই বে-আক্কেলটা দেখছি আমাকে আস্ত চিবিয়ে খাওয়ার ধান্দায় উঠেপড়ে লেগেছে। আচ্ছাসে
ধোলাই দিতে পারলে আমার.......Õ
মোল্লা আর দেরী না করে শুতে গেল। বালিশ গুছিয়ে যেই না মাথা দেবে, সেই সময় পেঁপে ভাইয়া প্রশ্ন করে মোল্লাকে চমকে দিলো।
প্রশ্নটা ছিলো, Ôকিছু যদি মনে না করেন হুজুর একটা কথা জিজ্ঞাসা করি? আপনার ওই স্টীলের হাঁড়িতে কী আছে হুজুর?Õ
মোল্লা বালিশে মাথা দিতে গিয়েছিল। পেঁপে ভাইয়ার কথা শুনে যেন লাফিয়ে উঠলো।
Ôও কিছুনা, একটু জল খাবার আর কি। তবে হ্যাঁ, তোমরা কিন্তু ওর ধারে কাছেও যেয়ো না। ওটা এমন একটা মানুষের খাবার, যে কিন্তু মিষ্টি খায় না, অর্থাৎ আমি। সবকিছু করলা
দিয়ে বানানো। আমার কাছে তো ভালোই লাগে। কিন্তু তোমাদের কাছে
কেমন লাগবে আমি তা বলতে পারছি না। সোজা হাসপাতালে চম্পট দিতে
হবে বমি করতে করতে, বুঝলে।Õ
Ôঠিক আছে হুজুর। আমি থাকতে আপনার কোন টিউশন নেই।Õ
Ôআরে ভাইয়া, টিউশন নয়, টিউশন নয়। tension,
tension।Õ
Ôসে যাই হোক। হুজুর সাহেব, আপনি শুয়ে পড়ুন। আর হ্যাঁ, একেবারেই চিন্তা করবেন না। আমি থাকতে কোনো বাপের বেটা আপনার হাঁড়ি ডিশটয় করতে পারবে না।Õ
Ôআরে ভাইয়া, কথাটা হবে destroy। প্র-প্র-প্র-প্রথমবারই ঠিক বলেছিলে, এবার আবার কী হলো?Õ
আমি মাঝখান থেকে বললাম, Ôপেঁপে ভাইয়া, এবার ইংরেজি কথা গুলো শিখেই নাও। সামনে বছর এসএসসি পাস নেহি কারোগে কেয়া?Õ
Ôদ্যাখ নসু, ফাজলামো করবি না। তাহলে কিন্তু জাহান্নামে যাবি।Õ
আমি মনে মনে বললাম, Ôতুমি কাছে থাকতে সত্যি
কী জাহান্নামের আর দরকার আছে?Õ
৩
আমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি।
আমি দইয়ের নদীতে গোসল দিচ্ছি আর দই খাচ্ছি। হঠাৎ
নদী থেকে একটা দৈত্য বের হলো। আমি চিৎকার দিয়ে পালাবো ভাবছি। তখন সেই দৈত্য আমাকে ধরে ফেলল আর হাত দিয়ে গুতো মারতে লাগলো। আর বলতে লাগলো, Ôআরে এই হতচ্ছাড়া নসু। কুম্ভকর্ণ হয়ে গেলি নাকি? তাড়াতাড়ি ওঠ।Õ
আমি জেগে উঠলাম। দেখে পেঁপে
ভাইয়া একটা কলমের ডগা দিয়ে আমার পেটে কাতুকুতু দিচ্ছে। তাহলে আমার
স্বপ্নের দৈত্যটি পেঁপে ভাইয়া ছাড়া আর কেউ নয়। দৈত্যের চেহারা মনে করে দেখলাম। ভাইয়ার সাথে অনেকটা মিল আছে। আমার খুব হাসি পাচ্ছিলো। পেঁপে ভাইয়া আবার বলে উঠলো, Ôনেহাত দলের লোক বলে তোকেও ডাক দিলাম। তাড়াতাড়ি
ওঠ। না হলে কিন্তু হাওয়া পাবি।Õ আমি দেখলাম ন্যাড়ার বিছানায় বসে বোম আর ন্যাড়া মোল্লা সাহেবের হাঁড়ি থেকে
রসগোল্লা আর চমচম তুলে সাটাচ্ছে।
Ôইয়েসাব কেয়া হোরাহাহ্যা?Õ
Ôআরে গবেট, বুঝিস নি? মোল্লা ওর হাঁড়িতে করে ঐসব নিয়ে এসেছিলো। আমরা যাতে টের না
পাই সেজন্য বলেছে যে ওতে করল্লা আছে। দেখ, কী আজব ম্যাটার!!!Õ
ন্যাড়া কিছু একটা বলবে। কিন্তু চমচমের চাপে বলতে পারছে না। অনেক কষ্টে চমচমটা গিলে তারপর
কথা বলা শুরু করলো, Ôমোল্লাসাহেব
বলেছিলেন তেতে-তে-তেতো!
খুউব তেতো! কিন্তু এখন তো
দেখছি মিষ্টি!! খুউউউউব মিষ্টি!! আমার জি-জি-জিভ কচকচ করছে। কী হাই লেভেলের মিষ্টিরে বাবা!Õ
Ôসে যাই হোক, ওরে নসু, দাতি লেগে গেলি নাকি? তাড়াতাড়ি আয়। নাহলে কিন্তু আমরাই সব খেয়ে ফাইনিশ করে
দেব।Õ
আমি বসলাম পেঁপে ভাইয়ার বিছানায়। তারপর কে কার আগে সাটাতে
পারে?
আমরা একেবারে সেই খাওয়া খেলাম। পেঁপে ভাইয়ার তো কথাই নেই।
খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। আমরা বললাম, Ôভাইয়া, এবার থামো। মিষ্টি শেষ।Õ পেঁপে ভাইয়ার জ্ঞান নেই সেদিকে। হাঁড়ি হাতে
তুলে নিয়েছে। মিষ্টি শেষ। এবার রস চাটা শুরু করেছে।
বোম বলে উঠলো, Ôকাম সারিছে
রে, কাম সারিছে। পিপে ভাই তো দেখি এইব্যার মিষ্টির পাতিলডাও খায়া ফেলাইবো।Õ
ন্যাড়া উপদেশ দিলো, Ôখবরদার
ভাইয়া, হাঁড়িটা কিন্তু স্টীলের। পেটে গেলে কিন্তু আর হ-হ-হ-হজম হবে না।Õ
পেঁপে ভাইয়ার উত্তর, Ôমিষ্টি
এয়াট করতে করতে কি তোদের ব্রেন ডীসেবল হয়ে গেছে নাকি রে? আমি কি জীবনে এত বিগ একটা হাঁড়ি গিলতে পারি?Õ
আমি বললাম, Ôমিষ্টি
খাওয়ার সময় এত বড় বড় হাঁ করেছিলে যেন পুরো এই ট্রেনটা কেই নিগাল যাওগে।Õ
ন্যাড়া ইংরেজি ধরলো, Ôআবার এয়াট
বলছো কেন?
আগেই তো ব-ব-ব-বললাম কথাটা হবে eat। আর ডীসেবল নয়, কথাটা হবে disable। আশা ক-ক-ক-করি বুঝতে পেরেছ।Õ
Ôআমাকে শিক্ষা দেওয়ার বিফোর এ নিজে ঠিক করে লেয়ার্ন কর। এয়াট বানান দেখেছিস কোনদিন? E,
a
আর t। এয়াট। আরেকটা কথা ডিজেবল বানানে s আছে। তুই j কোথায় পেলি যে ডিজেবল বলছিস?Õ
Ôলেয়ার্ন নয়, কথাটা হবে learn।Õ
Ôতোকে শেখাতে গিয়ে আমি নিজেই ইংরেজি ফরগেট করে ফেলব।Õ
ওদিকে মোল্লা সাহেব গভীর ঘুমে ডুবে আছেন। এমন গভীর ঘুম, হা-না কিছুই নাই। আসলেই আল্লাহর কাছে চলে গেছে
মনে হয়। ওদিকে খেয়াল করে বোম বলল, Ôবাপরে বাপ। কী ঘুম
পারতিছে রে! গায়ের উপুড় দিয়্যা ট্রেন চইল্যা
গেলেও মনে হয় অ্যার ঘুম আর ভাংবি নাই।Õ
ন্যাড়া জবাব দিলো, Ôবোম ভাই, ঘু-ঘু-ঘুমাবে না কেন বলোতো? ৪৫ বছরের পুরনো ঘু-ঘু-ঘু-ঘুম বলে কথা!!!Õ
পেঁপে ভাইয়া ঘুমন্ত মোল্লার দিকে করুণার দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ
তাকিয়ে ছিলো। তারপর বলল, Ôআমার ঘাড়ে স্টিক
দিয়ে স্ট্রাইক করেছিল না?? তাই এই
পুনিশমেন্ট পেল।Õ
Ôআরে ভাইয়া, কথাটা পুনিশমেন্ট
নয়,
punishment হবে।Õ
Ôআরে ধুর!!Õ
Ôধুর ধুর করো কেন। তোমার ভা-ভা-ভা-ভালোর জন্যইতো বলছি।Õ
Ôচুপ কর। ব্যাটা ইংরেজ। আমার কোন ভালোটা করছিস শুনি? এ
পুনিশমেন্ট বানানে u আছে। তাই উ-কার হবে। তুই উ-কার কে আ-কার বানিয়ে পানিশমেন্ট
উচ্চারণ করছিস কেন?Õ
বোম জিজ্ঞাসা করলো, Ôআর স্টিক
দিয়ে স্ট্রাইক!! ওইট্যা আবার কী?Õ
Ôস্টিক মানে লাঠি। আর স্ট্রাইক মানে আঘাত। মোল্লাসাহেব পেঁপে ভাইয়াকে
লাঠি দিয়ে মেরেছিলো না? তাই আই বলেছে স্টিক দিয়ে স্ট্রাইক করেছে। মানে লাঠি দিয়ে
আঘাত করেছে।Õ
পেঁপে ভাইয়া হাই
তুলতে তুলতে বলল, Ôএই তোরা স্টপ কর। আর মোল্লা তোমাকে বলছি, মরনিংয়ে ওয়েকআপ করে যখন হাওয়া খেতে হবে, তখন দেখবে কেমন মজা, কেমন মজা, কে এ এ এ এ ম ও ও ও ও মজা।Õ ভ্রুশ।
পেঁপে ভাইয়া ঘুমিয়ে পড়া শেষ। হাত মুখ কিছু ধোয়নি। আমরা হাতমুখ ধুয়ে
হাঁড়িটা আবার ভালো করে বাঁধলাম। আর যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়্লাম।
৪
রাত তিনটার সময় আমি আবার জেগে উঠলাম।
উঠে দেখি আমাদের খেপু মহারাজ ট্রেনে পদার্পন করেছে। আমি
ঠিকই অনুমান করেছিলাম। তিনটেই বেজেছে। সেটা তো হল। কিন্তু খেপু শোবে কোথায়? আমি জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে বললাম, Ôঐ ন্যাড়া আর পেঁপে ভাইয়ার মাঝখানে গিয়ে শুয়ে পড়।Õ
এমন সময় কি যেন একটা ঝামেলার কারণে ট্রেনের সব লাইট নিভে
গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এবার কী করা যায়? আমি টর্চ লাইট বের করার জন্য তার ব্যাগে হাত ঢুকালাম। পেয়েও গেলাম। কিন্তু এর
সুইচ কোথায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
ওদিকে খেপু পড়েছে মহা ঝামেলায়। ও সামনের দিকে এগোচ্ছে অনেক
কষ্টে। আর তার সামনেই বোম শুয়ে আছে। আমি ততোক্ষণে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ফেলেছি।
খেপুর দিকে আলো ফেললাম। আর দেখি খেপু আর বোম কেবল আধাহাত দূরত্বে। আমি বললাম, Ôখেপু, আর না।Õ তবে আমার কথার
মর্ম না বুঝে খেপু আরো জোরেশোরে একটা ধাপ দিল। আর তার ধাপটি পড়বি তো পড়, একেবারে বোম এর আকাশচুম্বী ভূড়ির ওপর!!
তারপর? তারপর আর কি? ও দাদুউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউ!
হ্যাঁ, এটাই ছিলো বোমের চিৎকার। যেকোনো মুহূর্তে তার
দাদুকে স্মরণ করে, বুঝি না! তবে চিৎকারটা এতোটাই জোরে ছিল যে আরেকটু হলেই ট্রেনের বগিগুলো
আলাদা হয়ে যেত।
ভাইয়া আর ন্যাড়া ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে। অন্ধকারে কেউ
কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। আগেই বলা হয়েছে খেপুর গায়ের রং এক্কেবারে শ্যামলা। তাই
একটু মজা পাওয়ার জন্য আমি করলাম কী, লাইট দিয়ে খেপুর হাতের উপর আলো ফেললাম। খেপু
তো অন্ধকারে হাত হাতরাচ্ছিল। তাই যখন আলো ফেললাম, তখন দেখা গেল, কালো একটা হাত নড়ছে। সেটা দেখলো স্বয়ং পেঁপে
ভাইয়া। তারপর......
Ôও খালাআআআআআআআআআআআআআআআআআআ!!!Õ
আরো একটা রাম চিৎকার। বোমের চেয়েও মারাত্মক।
এবার তো ট্রেনের বগিগুলো নড়েই উঠেছিলো। আর তারপরে আর কোনো কথা নাই। আলো ফেলে দেখা
গেলো পেঁপে ভাইয়া মেঝেতে ফিট হয়ে পড়ে আছে।
ন্যাড়া কিন্তু ভয় পায়নি। ও খুব সাহসী। খেপুর
হাতে একটা আংটি ছিল। ন্যাড়া সেটা দেখতে পেয়ে বলল, Ôখেপু তুই?Õ
এমন সময় হঠাৎ আলো চলে এলো। দেখা গেলো ন্যাড়া খেপুর হাত ধরে আছে। পেঁপে ভাইয়া চিত-পটাং।
বোম হা করে আছে। এতকিছুর পরেও দেখা গেলো মোল্লা সাহেবকে। নাক ডাকিয়েই চলেছেন।
ভ্রুউশ-ভ্রুত!! এতো জোরে দুইটা
চিৎকার হলো যে কবর থেকে কঙ্কাল জ্যান্ত হয়ে উঠে আসবে, তাও এ ব্যাটার ঘুম ভাঙ্গেনি!! আল্লাহর ধ্যান বলে কাকে!
আমি বোতল থেকে পানি এনে পেঁপে ভাইয়ের মুখের ওপর ছেটাতে
লাগলাম। ভাইয়া জেগে উঠেই আমাকে ধরে চেঁচাতে লাগলো, Ôভুত ভুত ভুত।Õ
Ôআরে ভুত না, ভুত না। খেপু, খেপু।Õ
Ôকী? খেপু? খেপু? খে এ এপু।Õ বলেই ঘুমিয়ে পড়া শেষ।
আমি খেপুকে বললাম ঘুমিয়ে পড়তে। আমিও চোখ মুখ ধুয়ে শুয়ে
পড়লাম। এমন সময় শুনতে পেলাম আশেপাশের বগিগুলোতে চ্যাঁচামেচি শুরু হয়ে গিয়েছে। নির্ঘাত বোম আর
পেঁপে ভাইয়ার চিৎকারের ফলে ট্রেনের সব লোক উঠে পড়েছ্। আমি ন্যাড়াকে কিছু করতে
বললাম। তখন ন্যাড়া তার
ব্যাগ থেকে একটা মাইক বের করল। তারপর ওখান থেকে বলতে লাগল...
Ôআমি সব যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমাদের বগিতে দুজন
ঘুমের মাঝে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখে চিত্কার দিয়ে উঠেছে। এটা এমন কোন ব্যাপার নয়! তবে তার
জন্য সবার মূল্যবান ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আমরা সত্যিই আন্তরিকভাবে দুঃখিত। যে যার মত শুয়ে
পড়ুন।Õ
ন্যাড়া খুব সহজে পরিস্থিতি সামলে নিলো। আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে
ঘুমাতে গেলাম।
৫
সকাল হয়ে গেছে। ট্রেন থেমে আছে এক স্টেশনে।
এটাই শেষ স্টেশন। তারপরের স্টেশনেই মামাবাড়ি পেয়ে যাবে আমরা।
সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। আমি উঠেছি সবার
পরে। উঠে দেখি পেঁপে ভাইয়া বসে আছে আর খেপু তার হাত পা টিপে দিচ্ছে। বোম জানালার
পাশে দাঁড়িয়ে নিজের ভুঁড়িতে হাত বোলাচ্ছে। ন্যাড়া তার ফার্স্ট এইড বক্স থেকে তুলো
বের করেছে আর কি যেন একটা মলমের মতন জিনিস তুলে ভাইয়ের মুখের কাছাকাছি মুছে দিচ্ছে।
আর মোল্লা তখনও ঘুমুচ্ছে।
আমি দাঁত ব্রাশ করতে লেগে গেলাম। ব্রাশ করতে করতে জিজ্ঞাসা
করলাম, Ôহামারা পেঁপে ভাইয়া কা কেয়া হুয়া? তুলা লাগাতে হচ্ছে কেন?Õ
বোম উত্তর দিলো, Ôপিপড় কামড়াইছে
গো, পিপড়। এই হাত্ত্যার হাত্ত্যার পিপড়। মনে হয় ডেঙ্গু পিপড়।Õ
ন্যাড়া ভেংচি কেটে বলে, Ôযাও, কিচ্ছু জা-জা-জানোনা। এডিস মশা কামড়ালে ডেঙ্গু হয়। পিপড়া কামড়ালে আবার ডেঙ্গু
হবে কেন?Õ
খেপু উত্তর করলো, Ôপিপীলিকার
দংশনেও ডেঙ্গুও যে হইতে পারে তাহা তো আমি পিতার জন্মেও শুনি নাই।Õ
আমি বললাম, Ôআরে, শুনবি
কি করে? ওটা তো একেবারেই অসম্ভব। বিলকুল পসিবল নাহি।Õ
ইতোমধ্যে পেঁপে ভাইয়া রেগে উঠলো। বলল, Ôআমি প্যানে প্যানে ডাই হয়ে যাচ্ছি, আর তোরা আমার ব্রেন নষ্ট
করার ফেস্টিভালে মেতেছিস?Õ
Ôআচ্ছা ঠিক আছে বাবা। আর বলব না। কিন্তু মোল্লাসাহেবকে ডাকবে
না? ট্রেন ছাড়তে তো আর ১০ মিনিটের মতো বাকি আছে।Õ
Ôআরে থামতো। ব্যাটাকে ঘুমুতে দে। আমাদের কিসের ঠেকা পড়েছে যে
ওকে তুলতে যাবো? দরকার হলে নিজেই উঠবে। তার বেরেকফাস্টের তো ব্যান্ড বাজিয়ে দিয়েছি,
উঠে যদি ওয়াটচ করে তো আমাদেরই ব্যান্ড বাজিয়ে দেবে।Õ
Ôযাই বলো না কেনো, ওঁর ঘুম ভাঙাতে হলে অন্তত পাঁচ মিনিট
চেষ্টা করতেই হবে।
বোম আমার কথায় বলল, Ôকী যে কও
নসু ভাই! খালি এক গেলাশ ঠান্ডা পানি লইয়া আসো। ছিটায়া দিলেই ওই ব্যাটা লাফাইয়া
উঠবো।
আমরা সবাই হেসে উঠলাম। আর সেই সময় বেজে উঠল হুজুরের মোবাইলে,
পিগ গাম বালি ডিলা পিগ গাম বালি বা!!!
ওরে বাবা!! মাওলানা মানুষ। তার ফোনের রিংটোনে বাজছে Magenta Riddim?? আমরা
তো অবাকেও অবাক। এও কী হয়? তাহলে আমার সন্দেহ একেবারে ঠিক। এ ব্যাটা মোল্লা নয়,
নিশ্চয়ই কোনো তেড়িবেড়ি লোক। আমি একটু মজা দেখার জন্য ফোনটা রিসিভ করে মোল্লা কানের
কাছে ধরলাম, যাতে কলার শুনতে পায় যে রিসিভার ঘুমাচ্ছে। তাও আবার বিচিত্র বিচিত্র
শব্দের নাক ডেকে। আশ্চর্য হওয়ার মতন কথা, যেই না মোবাইল হুজুরের কানে ঠেকিয়েছি,
ওমনি মোল্লা ধরফড়িয়ে জেগে উঠলেন। কী এমন হলো? কৌতুহল মেটানোর জন্য আমিও মোবাইলে
কান ঠেকালাম।
ওরে বাবা, যেন উড়ে যাচ্ছিলাম!! মোবাইলের ভেতরে যেন সুনামি
শুরু হয়ে গেছে। এত জোরেও কি মানুষ কথা বলতে পারে?
মোল্লা আমার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিলেন। তারপর নিজের কানে
ঠেকিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তখনই ট্রেন চলা
শুরু করলো। ধীরে ধীরে গতি বাড়ছে। মোবাইলটা রেখে মোল্লা আমাদের দিকে চোখ লাল করে
তাকালেন। বললেন, Ôহাতে সময় থাকলে
দেখিয়ে দিতাম আমি কি জিনিস। নেহাত ট্রেন ছেড়ে দিল, তাই আজ তোরা বেঁচে গেলি। না
হলে আজ তোদের কান ফর্সা করে দিতাম।Õ এই বলে মোল্লা বের হয়ে গেলো।
বোম আমার কানের কাছে আস্তে আস্তে বলল, Ôএ নসু ভাই, কান ফসসা করবি কিরম কইর্যা ভাই?Õ
আমি উত্তর দিলাম, Ôআরে গাধা
কান মুলে মুলে সব ময়লা তুলে দেবে। তখন তো ফর্সা হয়ে যাবে, তাই না?Õ
ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আমরা মোল্লাকে বাই
বাই করছিল। হঠাৎ মোল্লা পেছন ঘুরে চেঁচিয়ে উঠলেন, Ôআমার রসগোল্লার হাঁড়ি!!!Õ
Ôভুল টোল্ড করলেন হুজুর। রসগোল্লার হাড়ি নয়। পয়জনাস
স্ন্যাকের হাড়ি।Õ এই বলেই পেঁপে ভাইয়া দরজা দিয়ে সে হাড়িটা ছুড়ে দিলো মোল্লার দিকে।
হুজুর ছুটে এলেন। কিন্তু হাঁড়ি কি আর আস্ত আছে? ফেটে সালমান
খান, দুঃখিত দুঃখিত, খানখান হয়ে গেল। কিন্তু তাতেই বা কী? ওতে তো একফোটা রসগোল্লার
রসও নেই।
মোল্লা সাহেবের রাগ হয়ে গেলো। ক্ষ্যাপা ষাড়কে যেমন লাল কাপড়
দেখে তেড়ে আসে। তেমনি ট্রেনের পেছনে ছুটতে লাগল। ধরেও ফেলেছিল। আমাদের হাত পা
ঠান্ডা। এই বুঝি আমাদের হাসপাতাল পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে আল্লাহর দান।
রাস্তা কে যেন পটি করে রেখেছিল।
হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল মোল্লা। মনে হল যেন ভুমিকম্প। সাদা
পাঞ্জাবিটা গেল। ওটা দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি। আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। খানিকক্ষণ তো আমাদের নিঃশ্বাসও বন্ধ ছিলো মনে হয়।
অনেকক্ষণ পর আবার আওয়াজ শুরু হলো।
Ôবা-বা! খুশখুশাউল্লাহর হাত থেকে তো বাচ্চা বেড়িয়ে এলেম।Õ পেঁপে ভাইয়া এই বলে নিজেকে
সান্তনা দিচ্ছিলো। অমনি ন্যাড়ার পাকামো শুরু, Ôবাঁচা বলতে
গিয়ে কি জি-জি-জি-জিভটা লাফ মেরেছে নাকি পেঁপে ভাইয়া, যে বাচ্চা বেড়িয়ে এলো।Õ
Ôও তুই বুঝবি না। কত যে আরামের সাথে কথাটা বললাম তা বোঝার
বয়স কি তোদের হয়েছে?Õ
Ôনা, তাও বাচু কিংবা বাচ্চু বললেও তো হতো। তুমি
যে-যে-যে-যেভাবে বললে যেন এখনই তোমার......Õ
Ôঐ দ্যাখ! তুই আবার ব্যাড থ্যাংকিং শুরু করেছিস?Õ
Ôভাইয়া, থ্যাংক মানে হলো ধন্যবাদ দেওয়া, ওটা থ্যাংকিং নয়, Thinking হবে।
বু-বু-বুঝেছ?Õ
Ôএই আহাম্মক, আমার স্পেইলিং এ ভুল ধরতে তোকে কে বলেছে? আমি
যে স্পেইলিং করি তা আমার গর্ব, আমার অহংকার, আমার অহমিকা, আমার......Õ
পেঁপে ভাইয়া আটকে গেছে।
আমি মনে মনে বললাম, Ôগর্ব না
অন্যকিছু। তোমার ইংরেজি শুনলে কোনো ইংরেজ মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে হয় অজ্ঞান হবে,
আর নাহলে তোমাকে ধরে পেটানো শুরু করে দেবে।Õ
পেঁপে ভাইয়া আবার বলা শুরু করেছে, Ôআর যদি কোনো দিন আমার কথায় নোজ মিক্সার করিস, তবে তোর গালে
একেবারে কাটু চড় বসিয়ে দেব।Õ
এখানেই বলে রাখা দরকার কাটু চড়টা কী? সবাই জানো যে আমাদের
পেঁপে ভাইয়ার একেবারে লিকলিকে চেহারা। গায়ে বিশেষ শক্তি নেই। তবু একদিন প্রচন্ড
রাগে বোমের বাম গালে মেরেছিলো একটা চড়। সেই চড়টার নাম কাটু চড়। কারণ সেই চড়ে বোমের
মাংসবহুল গালটা দিয়েছিলো সমান্তরাল্ভাবে কেটে। সেই দাগ আজও আছে বোমের গালে। তাইতো
কাটু চড়ে আমাদের এত ভয়। অবশ্য ঐ শেষ। এরপর আর কখনো পেঁপে ভাইয়ার কাটু চড় খাওয়ার
সৌভাগ্য আমাদের আর কারো হয় নি।
৬
দিনাজপুর পৌঁছে গিয়েছি।
জায়গাটা বেশ মনোরম। তবে ঠান্ডা নাকি একটু বেশি। আমাদের মন্দ
লাগল না। তবে যত সমস্যা খেপুকে নিয়ে। ওর আবার বায়ু পরিবর্তন সহ্যই হয় না। ওখানে
গিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিলো। আর তারপরেই শুরু হলো, Ôহ্যাচ্চো।Õ
বোম আমাদেরকে পথ চিনিয়ে চিনিয়ে নিয়ে গেলো। আমি আর ন্যাড়া
মিলে খেপুর হ্যাচ্চো গুনছি। ২৫টা পার দিয়েছে। খেপুর তো একেবারে নাজেহাল অবস্থা।
বোম একটা বাড়ির সামনে এসে গেটে টোকা দিলো। দরজা খুলে গেলো। ভেতর থেকে বের হয়ে এলো
এক বিশাল গোফওয়ালা লোক। গায়ে মাংসের বড় অভাব। নেই বললেই চলে। দেখে বিশ্বাস হয় না
যে এটাই বোমের মামা। আমার সন্দেহ শুরু হলো।
বোম মনে হয় লোকটির মুখের দিকে তাকায় নি। সোজা গিয়ে লোকটাকে
জড়িয়ে ধরলো, কিন্তু জড়িয়ে ধরার পরই কেমন যেন একটা অপ্রস্তুত ভাব বোমের ভেতরে।
বিশাল বটগাছ মনে করে ভুলে একটা লিকলিকে বাঁশকে জড়িয়ে ধরলে যেমন অনুভুতি হয়, সেরকম
ভাব দেখা গেলো বোমের মুখে। তবুও জিজ্ঞেস করলো, Ôক্যাবা আচো মামা?Õ
লোকটাতো অবাক। বিষ্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছে বোমের দিকে। বোম
এখনো মনেহয় লোকটাকে দেখেনি। সে তার অসাধারণ ভাষা ব্যবহার করে লোকটির মগজে অব্যর্থ
নির্যাতন চালাচ্ছিলো। আর লোকটাও তেমনি, সব মেনে নিচ্ছিলো। হাঁ করে কেবল বোমের দিকে
তাকিয়ে আছে যে!!
একপর্যায়ে লোকটি বোমকে তার দেহ থেকে ছাড়িয়ে, দিলো একটা চড়।
মারাত্মক চড়! তবে অবশ্য পেঁপে ভাইয়ের কাটু চড়ের সমান হতেই পারে না। কাটুচড়কে যদি
চাঁদা দিয়ে মাপা যেতো, তাহলে বলতাম, এই চড়টা কাটু চড়ের চেয়ে ৬০ ডিগ্রী কম ওজনের। কিন্তু
এই চড়ে বোমের গাল কেটে না গেলেও হলফ করে বলতে পারি, ওর মগজটাকে নড়িয়ে দিয়েছে। তবে
আঙ্কেলটির এই রাগের কারণ কী? খুবই সহজ কারণ! বোমের ভুঁড়ির ভারে আঙ্কেল একেবারে
থেতলে গেছেন!!
আমরা খুব সহজেই বুঝে নিলাম যে এই লোকটা বোমের মামা নয়। কারণ
বোম নিজেই বলেছে যে ওর মামা নাকি ওর থেকেও ছয়শোগুণ মোটা!! ওখান থেকে আমাদের ফিরতে
হলো। রাস্তায় পেঁপে ভাইয়া ভাষণ শুরু করলো।
Ôতুই কি তোর চোখের হেড খেয়েছিস নাকি? মনে হচ্ছে তো, এতটুকু
পাওয়ারও নেই। এলিফ্যান্ট আর মাস্কুইটোর মধ্যেকার ডিফেরেঞ্চ বুঝিস না?Õ
ন্যাড়া জবাব দিলো, Ôএকটু
বে-বে-বেশিই হয়ে গেলো না? বো-বো-বোম ভাইয়ার মামাকে যদি হাতি ধরি, তাহলে এই লোকটাকে
বড়জোড় জিরাফ বলা যেতে পারে। তাই বলে ম-ম-ম-মশা? না না।Õ
আমাদের আর কথা এগোলো না। হাঁটতে হাঁটতে চলছি। সামনে পেলাম
একটা বিশাল গাছ। গাছটির নাম জানতাম না। তবে নাম জেনে কাজ কী? পেটের ভেতরে ভূমিকম্প
হয়ে যাচ্ছে। তাই ওই গাছের তলায় বসে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। খানিক্ষণ পর আবার
রওনা দিলাম। হাঁটছি তো হাঁটছিই। বোম এখনো আমাদের পথ চিনিয়ে চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সে নিজেই নিশ্চিত নয় যে কোনদিকে যাচ্ছে। এটা সে মুখে না বললেও ওর মুখের
রংচং দেখে যেকোনো বাচ্চাও বলে দিতে পারবে যে ও কী নিয়ে চিন্তিত।
বোমের এই হাবভাব আমার মোটেও সহ্য হলো না। সামনে দিয়ে একটা
লোক আমাদের দিকে আসছিলো। তাকেই দাঁড় করিয়ে বোমের মামার ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম। আমার
এই কাজে বোম আমার ওপর প্রচন্ড রেগে গেছে। পান্তুয়ার মতো চোখ দুটি অঙ্গার হয়ে গেছে।
তার নজরের মর্মার্থ ছিলো এই, Ôআমার ওপর তোমার
বিশ্বাস নাই নসু ভাই। তোমার পিঠে আজ আমি কাঁঠাল ভাঙবো।Õ আমি সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে লোকটার কথায় মনোযোগ
দিলাম। লোকটি বলছিল, Ôতোমরা বাড়িটা অনেক
পেছনে ফেলে এসেছ। আমার সাথে এসো। আমি ওদিকেই যাচ্ছি। তোমাদেরকেও নিয়ে যাই চলো।Õ
এই কথা যখন সবাই শুনলো তখন স্বাভাবিকভাবেই সবাই চটে গেছে
বোমের ওপর। আর বোম মহাশয় আগে যে রাগ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো, সেই রাগ নিয়ে
এবার আমি ওর দিকে তাকালাম। আমার তাকানোর মর্মার্থ ছিলো এই, Ôহতভাগা!! এতক্ষণ ধরে আমাদেরকে কোথায় কোথায় ঘোরাচ্ছিস? এইবার
তোর পিঠে কাঁঠাল ভাঙবো?Õ
মামার বাড়ির সামনে দিয়েই রাস্তা। একদম সামনে নয়, রাস্তা
থেকে বাড়ির গেট পর্যন্ত সোজাসুজি দশ কদম হাঁটতে হয়। রাস্তা থেকে আমাদের বাড়িটি
দেখিয়ে দিয়ে লোকটি বিদায় নিলো। আমরা দেখলাম গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটা
ব্যক্তি।
বুঝতে বাকি রইলো না কারোরই যে ওটাই বোমের মামা। শুধু বোমের
মামা কেন হবে? বোমের মামা মানে তো আমাদেরও মামা। আমরা মামার দিয়ে এগোতে লাগলাম।
বোম এগিয়ে যাচ্ছিলো কথা বলতে। কিন্তু পেঁপে ভাইয়া তাকে আটকে দিয়ে বলল, Ôতোর যাবার কোনো দরকার নাই। এইবার আমি যাবো।Õ
মামার সামনে গিয়ে পেঁপে ভাইয়া বলল, Ôহেই আঙ্কেল, মে উই গেট আউট?Õ
আমরা সবাই হাসতে হাসতে মরি। আর মামা তো একেবারে অট্টহাসি
হাসছিলেন। পেঁপে ভাইয়া একটু বেশিই অবাক হয়েছে। আমাদের দিক মুখ ঘুরিয়ে বলল, Ôআমার কথায় তোদের এত লাউঘটার পায় কেন?Õ
ন্যাড়া বলে দিলো যে কথাটা হবে laughter, যার অর্থ হলো
হাসি। কিন্তু এই চিরন্তন সত্য আমাদের ঘিলুবিহীন মগজবান পেঁপে ভাইয়া বুঝবে কীভাবে?
আর তাঁকে বোঝাবেই বা কে? কাটু চড়ের ভয়ে সবাই ভীত।
তারপর আমাদের সাথে আলাপ-সালাপ হলো। মামা তো ভীষণ খুশি।
বিশেষ করে পেঁপে ভাইয়ার মতো একজনকে পেয়ে মামার খুশি মনে হচ্ছে দ্বিগুন হয়ে গেছে।
মামা আমাদের সকলকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন। ভেতরে গিয়ে চোখ ধাধিয়ে গেলো। বাইরে যেমন
বিশাল দেখলাম, ভেতরটা তার চেয়ে আরো বিশাল। অবশ্য মামা যেরকম, বাড়ির অন্যরাও হয়তো
সেরকমই হবে। মামা যখন সবাইকে ডাকলেন, তখন দেখলাম আমার অনুমানটা সত্যিই সত্যি।
৭
আমরা পৌঁছতে পেরেছি বিকাল পাঁচটায়।
ওখানে গিয়েই বিকাল। কিন্তু শীতকাল তো? বিকালকে যেন খুঁজেই
পাওয়া যায়না। ৫টা বাজতে না বাজতেই সন্ধ্যার আগমন শুরু হয়। মামা বললেন, Ôফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নাও। তারপর চলো, একপাক রাউন্ড দিয়ে
আসি।Õ আমাদের তখন বেশ
কাহিল অবস্থা। এত অভিজ্ঞতার ভার সইতে পারিনি। শুধুমাত্র এটা মনে আছে যে আমরা
হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পালটে নিলাম। তারপর মামাকে হয়তো জিজ্ঞেস করেছিলাম, Ôমামা, আমাদের ঘরটা কোথায়?Õ তারপর আর কিছুই মনে নেই।
চোখ খুলে দেখি সকাল হয়ে গেছে। একটা বিশাল ঘরে পাঁচটি আলাদা
আলাদা বিছানায় আমরা শুয়ে আছি। সবাই তখনো নিজ নিজ আত্মাকে ছেড়ে দিয়ে আছে। শুধু বোম
উঠে বসে আছে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পাওয়া গেলো। বোম উঠে দিয়ে দরজা খুলে
দিলো। ভেতরে ঢুকলো একটা মেয়ে। চায়ের ট্রে হাতে। না, মেয়ে বললে ভুল হবে। চলনক্ষমতা
সম্পন্ন একটা এক মণ মাংসপিণ্ড!!
বোমের সাথে সে কি কথাবার্তা! কথা শেষ হওয়ার পরে বোম পরিচয়
করিয়ে দিলো, Ôআমার ছুট্টূ মামাতো বোন। ক্লাস
ওয়ানে পড়ে। নাম শ্রীমতী ভটেশ্বরী চক্রবর্তী। ডাকনাম গোপি।Õ
একে তো প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুম, তারপর আবার এই মেয়েটির সাথে
সাক্ষাৎ!! ওরে বাবা, আমার মাথা তখনো ঢুলছে। হাই, হেল্লো কিছু নাই। সরাসরি জিজ্ঞেস
করলাম তাকে, Ôআচ্ছা গোপি, তোমাদের বাসায় যে বিশাল
দাড়িপাল্লা দেখলাম, ওটা কিসের জন্য?
Ôফসল মাপার জন্য। আমরা এখনো দাঁড়িপাল্লা দিয়েই ফসল মাপি।Õ
Ôতার জন্য তো বাটখারা লাগে। কয়টা আছে?Õ
Ô৮টা। ২০ গ্রাম, ১০০ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম, ১ কেজি, ২ কেজি, ৫
কেজি, ১০ কেজি আর ২০ কেজি।Õ
Ôআর ১ মণ? ১ মণ নেই নাকি?Õ
Ôদরকার হয় না। ১ মণের মাপার সময় আমিই দাঁড়িপাল্লায় উঠে পড়ি।
আমার ভর একেবারে ১ মণ।Õ
বোম বলল, Ôনসু ভাই, এইটা
আবার ক্যাবা প্রশ্ন হইলো? এইসব রাখো আর চা খাও।Õ
খেপু আর ন্যাড়াকে একবার ডাক দিতেই উঠে পড়লো। কিন্তু পেঁপে ভাইয়া
উঠছে না। ভাইয়া খুব ছটফট করছে, আর ঘামছে। আন্দাজ করলাম হয়তো কোনো ভয়ঙ্কর স্বপ্ন
দেখছে। পেঁপে ভাইয়ার অবস্থা থেকে আমরা সবাই যখন হাবার মতো হাঁ করে আছি, তখন গোপি
বলল, দাঁড়াও, আমি দেখছি।
গোপি গিয়ে পেঁপে ভাইয়ার পাশে বসল। তাতে পেঁপে ভাইয়ার ঘামের
তেজ বেড়ে গেলো মনে হলো। এবার গোপি করলো কী, এক কাপ চা পেঁপে ভাইয়ার মুখ সোজা উপরে
তুলল। এবার কাপটা সামান্য একটু কাঁত করলো। অমনি এক ফোঁটা গরম চা গিয়ে পড়লো পেঁপে
ভাইয়ার একেবারে নাকের ডগায়। পেঁপে ভাইয়া তো হুড়মুড়িয়ে উঠে চ্যাচাতে লাগলো, Ôদানোব দানোব, প্যান্ট প্যান্ট!!!Õ
ন্যাড়া আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, Ôনসু ভাই। আর যে পারি না। পেটের ভেতর গুড়গুড় করছে। পেঁপে
ভাইয়ার অশুদ্ধ ইংরেজির শুদ্ধ উচ্চারণগুলি পেটের ভেতর হয় কুতকুত খেলছে, নাহলে
পাত্তা পাত্তা খেলছে। বের না করে পারছিই না।Õ
আমিঃ বলে ফ্যাল রে গাধা, বলে ফ্যাল। বলে ফেললে হয়তো পেঁপে
ভাইয়ার দু-এক ঘা খেতে হবে তোকে। তাতে তুই মরবি না। কিন্তু পেটের ভেতর ওগুলো থাকলে
নিশ্চয়ই তোর হার্ট ৩৩ এর নিচে নাম্বার পাবে।Õ
Ôকী বললে?Õ
Ôবাহ!! পেঁপে ভাইয়ার ইংরেজি ধরার পর এমন ভাব দেখাস যেইছে কি
ইচ দুনিয়ামে তেরি তারহা অর কোয়ি নাহি (যেন এই দুনিয়াতে তোর মতো আর কেউ নেই)। আর
এইটুকু একটা বাগধারা বুঝতে পারলি না? আরে আমি বলছিলাম যে পেঁপে ভাইয়ার ইংরেজি না
ধরলে তোর হার্ট ৩৩ এর নিচে নাম্বার পাবে, মানে হার্ট Ôফেল করবে!!Õ
ন্যাড়া খানিকক্ষণ আমার কথাটা ভেবে দেখলো। তারপর সটান সোজা।
একটু চিৎকার দিয়েই বলল সে, Ôকীসের প্যান্ট প্যান্ট
করছ ভাইয়া। কথাটা হবে Giant, Giant মানে দানোব।Õ
আমরা সবাই হেসে লুটোপুটি। বোমকে দেখলাম গড়াগড়ি দিয়েছে। খেপু
তো গড়াতে গড়াতে পড়েই গেলো। ন্যাড়া অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে। ৫/৬ ঘণ্টা ধরে বড় কাজটা
আটকে রাখার পরে, টয়লেটে ঢুকে কাজটা সেরে এলে মানুষের মুখের সাইজ যেমন হয়, অনেকটা
সেইরকম আভাস দেখলাম ন্যাড়ার মুখে। পেঁপে ভাইয়া মনে হয় শুনতে পায়নি। তখনো হাঁ করে
দেখছে গোপীকে। তারপর বলে উঠলো, Ôএতদিন হেয়ার করে
এসেছি যে ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। আজ হ্যান্ডে-ন্যান্ডে প্রুভ পেলাম।Õ
আমরা অবশ্য বুঝতে পারিনি যে হ্যান্ডে-ন্যান্ডে মানে কী।
ন্যাড়াকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে পেঁপে ভাইয়া নাকি ÔহাতেনাতেÕ বলতে গিয়ে হ্যান্ডে-ন্যান্ডে বলেছে।
যাক, ব্রেকফাস্টঁ পর্ব এখানেই শেষ। দুপুর পর্যন্ত কাটলো।
আবার মজা হলো দুপুরে খাওয়ার সময়। এবার সেটা বলি।
গোসল করে এলাম সবাই। সময় হলো খাবার। ডাইনিং রুমে গিয়ে
দেখলাম ইয়া বড় বড় চেয়ার। বোমের মতো তিনজন আটবে। ডাইনিং টেবিল তো আরো বড়। টেবিলে
সাজানো পঞ্চাশমতো বাটি, ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। সুঘ্রাণ বের হচ্ছে। সবাই চলে এলো। তখনই
পেঁপে ভাই বলল, Ôএত বিশাল লঞ্চ তো
জীবনে দেখিনি।Õ
কাজের মেয়েগুলো প্রায় শব্দ করে হেসে ফেলল। পেঁপে ভাইয়ার
সে-কি লজ্জা!! মনে হচ্ছিলো যেন এক ছুটে ঘর থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু তা যদি হয়,
তাহলে আমি বলব, পিকচার তো আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত!! কারণ পেঁপে ভাইয়া লুঙ্গি
পরে আছে। আর যখন লুঙ্গি পরছিলো, তখন আমরা দেখেছি, ওর লুঙ্গির গিট একেবারে নেমে
গেছে। যদি দৌড়ানোর চেষ্টা করে, তাহলেই......। আর বলা যায় না।
তা অবশ্য হলো না। বাঁচিয়ে দিলো ন্যাড়া। বলল, Ôআজ স-স-সকালে চা খাওয়ার স-স-স-সময় ভাইয়ার ঠোঁটের কোণা পুড়ে
গেছে। তাই আ বলতে পারছে না। আর সেই কারনেই লাঞ্চ না বলে লঞ্চ বলে দিয়েছে।Õ
কিন্তু ন্যাড়া যে সব বানিয়ে বানিয়ে বলেছে তা বুঝতে অবশ্য
কারো বাকি থাকলো না যখন সবাই পেঁপে ভাইয়ার খাওয়ার ধুম দেখলো। পুরো আস্ত খোক্কস
ফেল!! ওহ, ইলিশ মাছের পাতুরী আর চিংড়ি মাছের মালাইকারী যা হয়েছিলো না!!!

